Image description

গাজীপুরের টঙ্গীর কলেজগেট। ১৪ আগস্ট সকাল ১০টা। ঢাকাগামী উড়ালসড়কে একটাও গাড়ি উঠছে না। সড়কের মুখে দাঁড়িয়ে দুই ট্রাফিক সদস্য, নিচে থেমে থাকা যানবাহনের লম্বা সারি। কারণ একটাই—কমিশনার আসছেন।

গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারের প্রটোকলের জন্য উড়ালসড়ক ফাঁকা রাখতে হয়। আর এই সময়ে যাত্রী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী—সবার যাতায়াত থমকে থাকে। যানজটে হাঁসফাঁস করা মানুষের অনেকে জানেনও না, এই নগরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি থাকেন অন্য শহরে।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান থাকেন ঢাকায়। প্রতিদিন গুলশানের বাসা থেকে আসেন গাজীপুরে। ফেরেনও একইভাবে। যাওয়ার সময় টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় উড়ালসড়ককে একমুখী করে দেওয়া হয়। এ সময় গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী লেন বন্ধ হয়ে যায়। কমিশনারের ফেরার সময় একইভাবে একমুখী করে দেওয়া হয় গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার উড়ালসড়ক। তখন গাজীপুরমুখী চলাচল বন্ধ থাকে।

আমি শুধু গাজীপুরে গেলেই ডিস্টার্ব হয়, সচিব ও উপদেষ্টা মহোদয়রা ঢাকায় যে প্রটেকশন নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন, তাতে ডিস্টার্ব হয় না?
মো. নাজমুল করিম খান, জিএমপি কমিশনার

বিষয়টি সরেজমিন দেখার জন্য ১৪ আগস্ট সকাল সোয়া ১০টায় এই প্রতিবেদকদ্বয় গাজীপুরের দিক থেকে ঢাকামুখী যাত্রা শুরু করলে টঙ্গী কলেজগেট এলাকায় উড়ালসড়কের মুখে গাড়ি আটকে দেয় পুলিশ। কারণ জানতে চাইলে দায়িত্বরত দুই ট্রাফিক পুলিশ সদস্য রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম বললেন, ‘কমিশনার স্যার’ ঢাকা থেকে আসবেন এখন, তাই গাড়িগুলো উড়ালসড়কে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। ‘স্যার’ গাজীপুরে ঢুকলেই ঢাকাগামী উড়ালসড়কে সব ধরনের গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

এ সময় ঢাকামুখী লেনে গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়। সড়কে কথা হয় গাজীপুরের সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আবদুল মতিনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকাগামী উড়ালসড়কে কোনো গাড়ি উঠতে দেওয়া হয় না। ফলে উড়ালসড়কের নিচে পাশের লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়।

বিষয়টি উঠে এসেছে পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও। তাতে বলা হয়, জিএমপি কমিশনার নাজমুল করিম খান ঢাকা থেকে গাজীপুরে যাওয়ার সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১/১২টা পর্যন্ত গাজীপুর কলেজগেট থেকে ঢাকাগামী উড়ালসড়কে কোনো গাড়ি উঠতে দেওয়া হয় না। আবার রাতে জিএমপি কমিশনার যখন তাঁর কর্মস্থল গাজীপুর থেকে ঢাকার গুলশানের বাসায় যান, তখন উড়ালসড়কের গাজীপুরমুখী লেনে কোনো যানবাহন উঠতে পারে না। এতে গাজীপুর-ঢাকা যাতায়াতকারী বিভিন্ন অফিসের যাত্রী, ছাত্রছাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

জিএমপি কমিশনার মো. নাজমুল করিম খানের সঙ্গে ১৪ আগস্ট ও ২১ আগস্ট দুই দফা কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, ‘সিম্পল কথা, আমি শুধু গাজীপুরে গেলেই ডিস্টার্ব হয়, সচিব ও উপদেষ্টা মহোদয়রা ঢাকায় যে প্রটেকশন নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন, তাতে ডিস্টার্ব হয় না? আমার তো ওখানে (গাজীপুরে) বাসা নেই। কমিশনারের তো একটা বাংলো থাকার কথা ছিল, তাই না? বাংলো বানাইয়া দিতে বইলেন। আমি ওখানে ফ্যামিলি নিয়ে চলে যাব। একটা বাংলো বানাইয়া দেওয়ার জন্য একটা প্রতিবেদন লেখেন।’

নাজমুল করিম খান জিএমপি কমিশনার পদে নিয়োগ পান গত বছর ১১ নভেম্বর। চলতি বছরের ১ মে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন তিনি।

বিষয়টি উঠে এসেছে পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও। তাতে বলা হয়, জিএমপি কমিশনার নাজমুল করিম খান ঢাকা থেকে গাজীপুরে যাওয়ার সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১/১২টা পর্যন্ত গাজীপুর কলেজগেট থেকে ঢাকাগামী উড়ালসড়কে কোনো গাড়ি উঠতে দেওয়া হয় না।

কমিশনারের গাড়ি নিয়েও প্রশ্ন

জিএমপির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরে জিএমপি কমিশনারের জন্য গাজীপুরে সরকারি বাসা নেই। তাই কমিশনার ঢাকার গুলশানের বাসা থেকে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। তাঁর মতো জিএমপির দুই অতিরিক্ত কমিশনার জাহিদুল হাসান ও তাহেরুল হক চৌহানও ঢাকায় থাকেন। তাঁদের জন্যও সরকারি বাসা নেই। তাঁরাও ঢাকা থেকে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন।

জিএমপি কমিশনার যে গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করেন, সেই গাড়ি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নতুন সাদা রঙের গাড়িটি (প্রাডো) সরকারি নাকি ব্যক্তিগত, সেটাও পরিষ্কার নয়। গাড়িতে রেজিস্ট্রেশনের পূর্ণাঙ্গ কোনো নম্বর দেখা যায়নি।

এই বিষয়ে পুলিশের অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জিএমপিতে মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান উপকমিশনার (ট্রাফিক) থাকাকালে বর্তমান কমিশনারের জন্য একটি গাড়ি কিনে দেন। গাড়িটির রং সাদা। গাড়ির নম্বর প্লেটে ‘ঢাকা-৬৯৪ শ’ লেখা রয়েছে। ইব্রাহীম খান ‘ডাম্পিংয়ের’ জন্য আটক করা যানবাহন বেচাকেনা করেন। মাসোহারা থেকে প্রাপ্ত টাকা এই ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান জিএমপিতে ছিলেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। ৬ আগস্ট খুলনা রেঞ্জ উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

জিএমপি কমিশনার যে গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করেন, সেই গাড়ি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নতুন সাদা রঙের গাড়িটি (প্রাডো) সরকারি নাকি ব্যক্তিগত, সেটাও পরিষ্কার নয়। গাড়িতে রেজিস্ট্রেশনের পূর্ণাঙ্গ কোনো নম্বর দেখা যায়নি।

গাড়ির এই বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার নাজমুল করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাওয়ার ওপর কথা আমি বিশ্বাস করি না। রিপোর্ট আমার কাছে পাঠাইতে বলেন। তদন্ত করাতে হবে। আমার দিকে ইঙ্গিত করলে আমি স্পষ্ট করে বলব, উপদেষ্টা পর্যন্ত গেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমাকে দিয়ে থাকলে ওদিকে নিশ্চয় ম্যানেজ করেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে না কেন?’

এই বিষয়ে বর্তমানে ওএসডি থাকা মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। ফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার থাকাকালে পুরান ঢাকার বংশালে এক মুক্তিযোদ্ধার জমি দখলে ভূমিদস্যুকে সহযোগিতা করেছিলেন। এমন অভিযোগে তাঁকে ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি গাজীপুরে বদলি হন।

কমিশনারের ভাষ্য, সব দায় তাঁর নয়

গাজীপুর মহানগরে সরেজমিনে ঘুরে ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর শ্রমিক–অধ্যুষিত শিল্পনগরী গাজীপুরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়। পোশাকশ্রমিকসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা হঠাৎ করেই রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা সড়ক অবরোধসহ মিছিল নিয়ে মাঝেমধ্যেই গাজীপুর শহর প্রায় অচল করে দেন। শিক্ষার্থীরাও নানা বিষয়ে বিক্ষোভে নামেন। তখন তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। এমন সময়গুলোতে যদি কমিশনারকে কর্মস্থলে পাওয়া না যায়, মাঠপর্যায়ে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়।

এ বিষয়ে কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, ‘শিল্পনগরীর জন্য শিল্প পুলিশ আছে। শ্রমিকেরা যদি মহানগরের রাস্তায় না আসে, তাহলে শিল্প পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেন, তার এলাকার শ্রমিকেরা মহানগরে আসে কেন? সে বিষয়ে শিল্প পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। আবার ছাত্রদের স্কুলে থাকার কথা, তারা যদি স্কুলে না থেকে রাস্তা দখল করে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষের কি দায়দায়িত্ব নেই?’

এদিকে গাজীপুর শহরে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের একের পর এক ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। মাদকের ব্যাপক বিস্তারের ফলে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকেরা। কমিশনার নাজমুল করিম খান সার্বক্ষণিক এলাকায় না থাকতে পারায় সবকিছু সঠিকভাবে তদারকিতেও ঘাটতি পড়ে বা অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যেও ঢিলেঢালা ভাব থাকে বলে নাগরিক সমাজের অনেকে মনে করেন।

ঢাকা থেকে গাজীপুরে ঢোকা সময়সাপেক্ষ। গাজীপুর মহানগর এখন অপরাধীদের অনেকটা অভয়ারণ্য। যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটে যায় এখানে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে জিএমপি কমিশনার গাজীপুরে সার্বক্ষণিক থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত।
সুজন গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির

তবে কেবল কমিশনারই নন, গাজীপুর মহানগর পুলিশের আগের কমিশনারদেরও কেউ কেউ ঢাকায় থাকতেন। তখন সামগ্রিক রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পুলিশকে পুনর্গঠন, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনা, যখন-তখন উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও বাড়তি তদারকি জরুরি বলে মনে করে নাগরিক সমাজ।

এই বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে গাজীপুরে ঢোকা সময়সাপেক্ষ। গাজীপুর মহানগর এখন অপরাধীদের অনেকটা অভয়ারণ্য। যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটে যায় এখানে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে জিএমপি কমিশনার গাজীপুরে সার্বক্ষণিক থাকবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত। তিনি বলেন, গাজীপুর শহরে থেকে পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কমিশনারকেই উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে।