
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া সম্পর্কে ২৪টি রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে লিখিত মতামত জমা দিয়েছে। লিখিত মতামতে খসড়ার ভুলত্রুটি ও সংযোজন-বিয়োজনের প্রস্তাবের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছে দলগুলো, যার মধ্য দিয়ে সনদ চূড়ান্ত করা এবং এর বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সংবিধানের ঊর্ধ্বে জুলাই সনদকে রাখা, গণভোট, পিআর পদ্ধতি চালুসহ কয়েকটি বিষয়ে জোরালো মতবিরোধ রয়েছে। এই মতবিরোধ অবসানে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণের পাশাপাশি চলতি সপ্তাহেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপে বসবে ঐকমত্য কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুই দফা সংলাপ ও নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়া গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। খসড়ায় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে যেসব সংস্কারে ঐকমত্য ও নোট অব ডিসেন্টসহ (আপত্তি) সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা হয়। এতে পটভূমি, সংস্কার কমিশনগুলো গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন ও এর কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ঐকমত্যে উপনীত হওয়া বিষয়গুলো এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আট দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে। এর ভাষাগত, শব্দ, বাক্য গঠন বা কোনো বিষয়ে সংশোধনী বা মতামত থাকলে তা ২০ আগস্ট বিকেল ৪টার মধ্যে কমিশনের কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়।
দলগুলোর মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জুলাই সনদের খসড়া ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে সনদের অঙ্গীকারনামার কিছু ধারা নিয়ে দলগুলোর আপত্তি রয়েছে।
জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশই প্রাধান্য পাবে।
সনদ নিয়ে বিএনপির ‘ইতিবাচক’ অবস্থানের কথা জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদের অঙ্গীকার রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল বিধায় তা সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে আইনি, বৈধ এবং সাংবিধানিক উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নেও আশাবাদী বিএনপি।
জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, সনদের খসড়ার কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকলেও তারা বাস্তবায়নে আন্তরিক। জুলাই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে একমত তারা। একই সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশকে প্রাধান্যের বিষয়ে একমত দলটি। সনদের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকার পাশাপাশি আদালতে প্রশ্ন না তোলার বিষয়েও তাদের সমর্থন রয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো সুনির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যাপারেও জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে। ভোটের আগে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনও বেশ সোচ্চার। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের অবস্থানও এনসিপির কাছাকাছি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান হলো, কিছু আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই করতে পারে। আর সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কারগুলো আগামী জাতীয় সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এনসিপি কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই জুলাই সনদ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘আমরা এই মর্মে একমত যে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।’
লিখিত প্রস্তাবে এনসিপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চেয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে দলের অবস্থান তুলে ধরা হয়। সংসদে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন, সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত বিল পাসের প্রক্রিয়াসহ বেশ কিছু বিষয়ে জুলাই সনদের খসড়ার সঙ্গে এনসিপির মতপার্থক্য এতে স্থান পেয়েছে। মতামতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর স্থলে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ করার কথা বলেছে এনসিপি। এতে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করার কথা বলা হয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা নিয়ে এনসিপি বলেছে, ‘সাংবিধানিক কনভেনশনের নামে পরবর্তী সংসদের কাছে জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্বে বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তি প্রদান করার কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সংবিধান না থাকা নিয়ে কমিশনের বক্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’ সনদের খসড়ায় ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করেছে দলটি।
লিখিত মতামতে সিপিবি বলেছে, সনদের ভূমিকায় পাকিস্তানের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ ও একপেশে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতির কথা বলা হয়নি। এটা যুক্ত করা দরকার। সংকট তৈরি হয়েছে ৫৩ বছর ধরে, এগুলো না বলে শুধু একটা সময়ের কথা বলা হয়েছে। কিছু বিশেষ সময়ের সংকটের কথা বলা হয়েছে, যা একপেশে। এ ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া বিষয়গুলো ঐকমত্য বলা মোটেই যথাযথ নয়।
সিপিবি জানিয়েছে, সনদের বিধান প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিকভাবে আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না—এটি একটি ভয়ংকর বিষয়। এসব বক্তব্য সনদকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। আর বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে সনদের বিধান প্রাধান্য পাবে, এমন কোনো সুযোগ থাকাটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সিপিবি মনে করে, ঐকমত্যের অর্থ, যে বিষয়ে সবাই শতভাগ একমত। আর এগুলো বাস্তবায়ন করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ।
কমিশনে পাঠানো চূড়ান্ত মতামতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে আমার বাংলা (এবি) পার্টি। তারা বলেছে, পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া (সংশোধিত) প্রস্তাবের প্রারম্ভিক বক্তব্য এবং অনুচ্ছেদ ১ থেকে ৪-এ তাদের মতামতের অনেকাংশ প্রতিফলিত হয়েছে। এবি পার্টি প্রাথমিক অবস্থান পরিবর্তন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) খসড়ার অঙ্গীকারনামার অংশের ধারা ৪-এর বিরোধিতা করেছে। বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা ৭(ক) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকতে হবে। অঙ্গীকার অংশে জুলাই সনদের ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে শুধু আপিল বিভাগের উল্লেখ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দলটি। তারা বলেছে, আপিল বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার একটি সংজ্ঞায়িত আইনি প্রক্রিয়া আছে, যা অঙ্গীকার অংশে অনুপস্থিত। পরবর্তী সংসদ গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
জুলাই সনদের সব ধারার বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জোর সুপারিশ করেছে খেলাফত মজলিস। দলটি সংবিধান সংস্কারের জন্য অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করেছে। গণভোটে আপত্তি জানিয়ে দলটি বলেছে, “এই পদ্ধতি ‘সময়সাপেক্ষ’। তাই এটা এই মুহূর্তে গ্রহণযোগ্য নয়।”
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) পক্ষ থেকে জুলাই সনদকে সংবিধানে একটি পৃথক অধ্যায় হিসেবে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া দলটি খসড়া অঙ্গীকারের ধারা ৪ বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, গতকাল শনিবার সংসদ ভবনের কার্যালয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া লিখিত মতামত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। খসড়া সনদে সংযোজন ও বিয়োজনের প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন কমিশনের সদস্যরা। চলতি সপ্তাহেই আনুষ্ঠানিক সংলাপ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাইরে দলগুলোর মতবিরোধ থাকলেও জুলাই সনদ প্রণয়নে আমরা তাদের আন্তরিকতা দেখেছি। তাদের দেওয়া লিখিত মতামত কমিশন ও কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সমন্বয় করার পাশাপাশি সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা করছে। এরপর দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসা হবে।’ সবার মতামতের ভিত্তিতে দ্রুত জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।