Image description

ভারতীয় আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। শুল্ক ফাঁকির টাকা পরিশোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তাতে সাড়া মিলছে না, বরং এসআরও বা বিধিবদ্ধ আদেশ জারির মাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বিপিডিবি।

একদিকে এনবিআর চাইছে ফাঁকি দেওয়া শুল্ক আদায়, অন্যদিকে বিপিডিবি চাইছে এসআরও জারির মাধ্যমে শুল্কছাড় সুবিধা। এ নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একধরনের রশি টানাটানি চলছে।

বিপিডিবি বলছে, শুল্কছাড় না দেওয়া হলে বিদ্যুতের ট্যারিফ বা মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে। ট্যারিফ বাড়ানো না হলে এ অর্থ বিপিডিবিকে ভর্তুকি আকারে দিতে হবে। এ অবস্থায় শুল্ক মওকুফ ও আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত বাস্তবায়ন চুক্তির (আইএ) ১২.১ ধারা অনুযায়ী আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বিপিডিবির পক্ষ থেকে এনবিআরকে অনুরোধ জানানো হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমার দেশকে বলেন, আমরা শুল্কছাড়ের জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এনবিআর সে অনুরোধে সাড়া না দিলে চুক্তি অনুযায়ী বিপিডিবিকে সেটা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। এটা করতে হলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে। এখন মূল্যবৃদ্ধি করা না হলে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে শুল্ক পরিশোধের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে চাইব। সুতরাং শেষ পর্যন্ত এটা নিয়ে কি হবে? দুটো সরকারি দপ্তরের মধ্যে চিঠি চালাচালি ছাড়া কিইবা বলা যেতে পারে।

গত মার্চে রুহানপুর কাস্টমস স্টেশন আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক করের চার হাজার ৭৬৮ কোটি ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পরিশোধে বিপিডিবিকে চিঠি দেয়। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুল্ক মওকুফে এসআরও জারির জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছে বিপিডিবি। অবশ্য ২০২২ সাল থেকেই বিপিডিবি শুল্কছাড়ের বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি এনবিআর। সবশেষ গত ৭ জুলাই শুল্কছাড়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে বিপিডিবি। এ নিয়ে মোট সাত দফা বিপিডিবির পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আমার দেশকে বলেন, এটা (শুল্কছাড়) নিয়ে আমরা এখনো আলোচনা করিনি। আলোচনা করে আগে নিজেদের বিষয়টি বুঝতে হবে, তারপরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ২৫ বছরের চুক্তি করেছিল পতিত হাসিনা সরকার। এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ওই কেন্দ্র থেকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।

শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে অনিয়ম ও শুল্কফাঁকির বিষয়ে এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মোট ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হয়। অগ্রিম আয়কর ব্যতীত আমদানি করা এ পরিমাণ বিদ্যুতের মূল্যবাবদ ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ডলারেরও বেশি পরিশোধ করে বিপিডিবি। পরিশোধিত মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর হিসাবে পরিশোধিত মূল্যের ওপর মোট ৩১ শতাংশ শুল্ক ধার্য ছিল।

এ হিসাবে সরকারের কোষাগারে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ডলার বা চার হাজার ৭৬৮ কোটি ৪৫ হাজার টাকা জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিপিডিবি কোনো টাকাই জমা দেয়নি। মূলত ভারত থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে যে চুক্তি সই করা হয়, সেখানে শুল্ক মওকুফের কথা থাকলেও এনবিআরের পক্ষ থেকে শুল্কছাড়ের বিষয়ে কোনো ধরনের আদেশ জারি করা হয়নি। ফলে আদানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপিডিবির কাছ থেকে শুল্ক হিসাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায়যোগ্য বলে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে মত প্রকাশ করা হয়।

এদিকে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায়ে এনবিআরের আওতাধীন তিনটি বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। বিভাগ তিনটি হলোÑরাজশাহী কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূসক) ও ঢাকা কাস্টমস হাউস। এদের মধ্যে রাজশাহী কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের রুহানপুর কাস্টমস স্টেশন আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক আদায়ে বিপিডিবিকে চিঠি দিয়েছে।

আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক পরিশোধের দায় বিপিডিবির বলে স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম। চলতি বছরের মার্চে আমার দেশকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, চুক্তি অনুযায়ী শুল্কফাঁকির যে দায়, সেটা বিপিডিবিকে বহন করতে হবে। আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতির জন্য আমরা এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এনবিআর আমাদের অনুরোধ রাখেনি।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে ২০২২ সালের আগস্টে চিঠি দেওয়া হয়। এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম নামে ভারতীয় অন্য একটি কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে-এমন উদাহরণ তুলে ধরে আদানিও তাদের জন্য একই সুবিধা বহালের আবেদন জানায়। কিন্তু এনবিআরের পক্ষ থেকে আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের কোনো আদেশ জারি হয়নি।

অবশ্য বিপিডিবির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিকে বলা হয়েছে, এনবিআরের শুল্ক প্রকল্প সুবিধা, কাস্টমস আইন ১৯৬৯, মূসক আইন ১৯৯১-এর সংশ্লিষ্ট ধারার ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের সঙ্গে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারিতে সই হওয়া সমঝোতার আলোকে বিপিডিবির আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর প্রযোজ্য সব ধরনের শুল্ককরও মওকুফ করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তি ও এনবিআরের নির্দেশনার আলোকে বিদ্যুৎ আমদানি কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে মর্মে বিপিডিবি তাদের জবাবে উল্লেখ করেছে।

তবে বিপিডিবির এ বক্তব্য মানতে নারাজ শুল্ক ও কাস্টমস গঠিত তদন্ত কমিটি। তাদের বক্তব্য, দুদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানিতে সমঝোতা চুক্তি স্মারকে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আদান-প্রদান বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এটি সুনির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির কাছ থেকে আমদানির বিষয় নয় এবং শুল্ক অব্যাহতির বিষয়ে কোনো বক্তব্য উপস্থাপিত হয়নি।

তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আদানির সঙ্গে বিপিডিবি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতির কথা উল্লেখ রয়েছে। শুল্কছাড় বা অব্যাহতির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদেশ বা প্রজ্ঞাপন অনুমোদনের দায়িত্ব বিপিডিবির। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে শুল্ক-করের বিষয়ে কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হলে বিপিডিবি তা পরিশোধ করবে। যেহেতু আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়নি, সেক্ষেত্রে বিপিডিবিকে পরিশোধিত মূল্যের ওপর ধার্যকৃত শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।