
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। নির্বাচন সামনে রেখে ডাকসুর পাশাপাশি হল সংসদের প্যানেল নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হল সংসদে ছাত্রদল ছাড়া প্যানেল দেয়নি অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন। অনেকেই মনে করছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে ছাত্র রাজনীতি না চাওয়ায় ছাত্রদল বাদে বাকি ছাত্র সংগঠনগুলো হলে আনুষ্ঠানিক প্যানেল ঘোষণা দেয়নি। এছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের বিরদ্ধে ক্যাম্পাসে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ডাকসুর ২৮ পদের বিপরীতে ৫০৯ জন প্রার্থী হয়েছেন। ডাকসুতে ভিপি (সহসভাপতি) ও জিএসসহ (সাধারণ সম্পাদক) প্রতিটি হল সংসদে পদ আছে ১৩টি। সে হিসাবে সব হল মিলিয়ে মোট ২৩৪টি পদ আছে। এর বিপরীতে এবার প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে ১ হাজার ১০৮ জন শিক্ষার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে।
সোমবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বলছে, সংগঠনটির মনোনীত প্যানেলগুলোর বাইরে সব নেতাকর্মীকে নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হবে। এই নির্দেশ অমান্যকারী সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শনিবার রাতে শাখা ছাত্রদল থেকে এক নির্দেশনায় এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তদাধীন হল শাখাগুলোর অনেক নেতাকর্মী ডাকসু ও হল সংসদগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করেছেন। ছাত্রদল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীরা বাদে তাদের সবাইকে যথানিয়মে নিজ নিজ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে। এই নির্দেশনা অমান্যকারী সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন আজ এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ডাকসুতে সব ছাত্র সংগঠন প্যানেল দিলেও ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে আবাসিক হলগুলোতে-কারণ ছাত্রদল ছাড়া সেখানে প্যানেল দেয়নি অন্যরা। অনেকেই মনে করছেন ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। ফলে ছাত্র সংগঠনের নামে প্যানেল দিলে ভোটের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বিধায় তারা নিজেদের নামে প্যানেল দেয়। এদিকে ছাত্রদের ১৩টি হলেই পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পেরেছে ছাত্রদল। তবে ছাত্রীদের পাঁচটি হলের মধ্যে শুধু রোকেয়া হলে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল রয়েছে। এছাড়া কবি সুফিয়া কামাল হলে ৯টি পদে, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ৩টি পদে, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৬টি পদে ও শামসুন নাহার হল সংসদে ৫টি পদে প্রার্থী দিয়েছে ছাত্রদল। অবশ্য এই চার হলের ভিপি ও জিএস পদে ছাত্রদলের প্রার্থী আছে। এদিকে ছাত্রী ভোটারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ভোটার ৫ হাজার ৬৪১ জন, শামসুন নাহার হলে ৪ হাজার ৮৪ জন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ২ হাজার ১০৩ জন, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৪ হাজার ৪৩৪ জন ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ২ হাজার ৬৪০ জন। ছাত্র ভোটারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলে ১ হাজার ২৯৫ জন, কবি জসীমউদ্দীন হলে ১ হাজার ৩০৩ জন, জগন্নাথ হলে ২ হাজার ২২২ জন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ১ হাজার ৬০৬ জন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ১ হাজার ৯৯৮ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ১ হাজার ৭৬২ জন, বিজয় একাত্তর হলে ২ হাজার ২৭ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ১ হাজার ৭৪৯ জন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ১ হাজার ৯৫৭ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬৬৪ জন, সূর্য সেন হলে ১ হাজার ৪৯৯ জন, স্যার এএফ রহমান হলে ১ হাজার ৩৭৭ জন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ১ হাজার ৪০২ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, আমরা আমাদের দলের রীতি অনুযায়ী হল সংসদের প্যানেল ঘোষণা করেছি । ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনেও আমরা এই পন্থা অবলম্বন করে প্যানেল দিয়েছিলাম।
ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদপ্রার্থী এসএম ফরহাদ বলেন, ‘হলে রাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ায় এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতামত নিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলাম। এই মতামতের ভিত্তিতে হলে রাজনীতির বিষয়ে একটা রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রশাসন তা করেনি। সব মিলিয়ে হলে রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যেহেতু দ্বিধাগ্রস্ত, তাই আমরা হলে প্যানেল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমরা অনেকের সঙ্গে আলাপ করছি। আমাদের কর্মীদের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে প্রার্থী হওয়া অনেককে আমরা সমর্থন দিতে পারি।’
এদিকে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন কমিশন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
যদিও ডাকসু ও হল সংসদ আচরণবিধির ২(ক) নম্বর অনুচ্ছেদের ‘মনোনয়নপত্র দাখিল ও প্রত্যাহার’ পয়েন্টে বলা আছে-মনোনয়নপত্র সংগ্রহ এবং দাখিলের সময় কোনো প্রকার মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। বিধিমালা অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত কোনো প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে পারবেন না। এর মধ্যে ব্যানার টাঙানো ও স্লোগান দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে, যা নির্বাচনি আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়া হলগুলোতে প্রার্থীরা গ্রুপ করে প্রতিটি রুমে রুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। শনিবার ডাকসুর বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে এই ধরনের অভিযোগও তুলে ধরেন।
এর আগে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কেউ হল কিংবা ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালাতে পারবেন না। মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) থেকে প্রার্থীরা প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। বিধিনিষেধ অমান্য করে প্রচারণা চালালে এটি ডাকসু নির্বাচন ২০২৫-এর আচরণবিধি ভঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে চিফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, আমরা তাদের সতর্ক করে দিয়ে আরেকটি নোটিশ পাঠাচ্ছি। কোনো প্রার্থী নির্বাচনি বিধিনিষেধ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিন ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে ভিপি পদপ্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে আমাদের প্রতিযোগীরা ছাত্রশিবিরের মেধার সঙ্গে না পেরে আমাদের বোনদের বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং করছে। আমাদের বিরুদ্ধে তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি আশা করব আমরা এমন কোনো কাজ করব না যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ালিটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সাদিক বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সৃষ্টিশীল মেধা সৃষ্টি করা। সে মেধা সৃষ্টির অন্যতম স্থান আমাদের লাইব্রেরি। কিন্তু আমাদের লাইব্রেরির অবস্থা জরাজীর্ণ। এখান থেকে বই কেউ হলে নিয়ে যেতে পারে না। লাইব্রেরির আর্কাইভে সমস্যা। আমরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির আমূল পরিবর্তন করব। আমাদের এই লাইব্রেরি হবে ইন্টারন্যাশনাল মানের লাইব্রেরি। এ সময় ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে জিএস পদপ্রার্থী এসএম ফরহাদ অভিযোগ করেন, আমরা দেখছি অনেকেই ভিডিও ছাড়ছে যেখানে কেউ কোনো সংগঠনকে কেন ভোট দেবেন বা দেবেন না তা বলছেন, যা সুস্পষ্ট আচরণবিধি লঙ্ঘন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য প্রার্থী জয়েন উদ্দিন সরকার তন্ময়কে ‘বাদ’ দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তা নিয়ে সমালোচনার পর এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে সংগঠনটি। শিবিরের প্যানেলের এক প্রার্থী এবং কেন্দ্রীয় কমিটি বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্র অধিকার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী জয়েন উদ্দিন সরকার তন্ময়কে বাদ দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেটের কথা মাথায় রেখে আমরা তাকে প্যানেল থেকে বাদ দিয়েছি।’
শনিবার ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেন ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন। তিনি বলেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ঢাবি প্রশাসন এখন নানা কৃত্রিম সংকটের মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে। আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি প্রার্থীদের ছবি ও নাম হালনাগাদ করার জন্য। কিন্তু তারা বলছে এটা নিয়ে অনেক সমস্যা হবে। আমাদের বিশাল একটা ভোটার অনাবাসিক শিক্ষার্থী। আমরা যখন দাবি নিয়ে প্রশাসনের কাছে গেলাম, তারা বলছে হল কার্ড হালনাগাদ না করলে ভোট দিতে পারবে না।
তিনি বলেন, ‘জুলিয়াস সিজারও নির্বাচন করছেন, আমরাও করছি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার মানে এসব নিয়ে আমরা রেগুলার আন্দোলন করব। তারপর মারামারি হবে। তখন বলা হবে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ নেই। এসব নানা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমাদের ডাকসু নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা অনেক ফাইট করার পর ডাকসু আজ এ পর্যন্ত এসেছে। আমরা কোনোভাবেই ডাকসু নির্বাচন বানচাল হতে দেব না। যারা এভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট আয়োজন করার দাবি জানান।