
চোর সন্দেহে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ‘মব’ করে পিটিয়ে হত্যা করা কিশোর রিহান উদ্দিন মাহিনের বাবা মোহাম্মদ লোকমান বলেছেন, ‘আমার ছেলেসহ ওর দুই বন্ধুকে ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত একটানা পেটানো হয়। ছেলে পানি চাইলেও তাকে পানি পর্যন্ত দেয়নি খুনিরা। আমি যখন ছেলেকে বাঁচাতে যাই, তখন হত্যাকারীরা আমাকেও বেধড়ক পেটাতে থাকে। চোখের সামনেই আমার ছেলেটার মৃত্যু হয়েছে।’
শনিবার (২৩ আগস্ট) আহাজারি করতে করতে কালবেলাকে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে শুক্রবার (২৩ আগস্ট) ভোরে ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের চেঙ্গারমুখ ব্রিজ এলাকা থেকে চোর সন্দেহে মাহিন (১৫) এবং তার দুই বন্ধুকে আটকের পর ‘মব’ করে বেধড়ক পেটানো হয়। এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মাহিন। পিটুনিতে গুরুতর আহত মাহিনের সমবয়সী দুই বন্ধুকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহত মাহিন কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মোহাম্মদ তালুকদার বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকত। এক বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে মাহিন ছিল ছোট। তার বাবা লোকমান কাঞ্চন নগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় আঙিনার খুদে দোকানি। সরেজমিন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার ভ্রমণ শেষে মাহিন এবং তার দুই বন্ধু মানিক ও রাহাত বৃহস্পতিবার রাতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চট্টগ্রাম শহর থেকে বাড়িতে ফিরছিল। ভোরে তিন বন্ধু কাঞ্চন নগরের নিজ এলাকায় পৌঁছলে কিছু প্রতিবেশী তাদের চোর আখ্যা দিয়ে ধাওয়া দেয়।
এ সময় তারা প্রাণভয়ে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়। পরে সেখানে থেকে জোরপূর্বক তাদের নামিয়ে চেঙ্গারমুখ ব্রিজের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত এলোপাতাড়ি বেধড়ক পেটানো হয়। এতে তিন কিশোরই গুরুতর আহত হয়। এক পর্যায়ে মাহিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার রাতে স্থানীয় ভোলা গাজী জামে মসজিদ মাঠে মাহিনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নেওয়া লোকজন এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। পরে সামাজিক কবরস্থানে মাহিনকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় তার মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে ফটিকছড়ি থানায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ জনের বিরুদ্ধে ফটিকছড়ি থানায় মামলা করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
শনিবার মাহিনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে আছে চারপাশ। ১৫ বছরের ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার মা খাদিজা বেগম। এর আগে শুক্রবার রাতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলেকে শত্রুতা করে পিটিয়ে হত্যা করেছে। মাইজপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মাহিনের বন্ধুত্ব সহ্য করতে না পেরে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে খুনিরা। আমার ছেলের হত্যার বিচার হতে হবে খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, না হলে আমি আর আমার স্বামী বিষের বোতল নিয়ে জজের (বিচারক) সামনে যাব এবং সেখানেই বিষপানে আত্মহত্যা করব। ছেলে ছাড়া আমাদের জীবন মূল্যহীন।’
কাঞ্চননগর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল কাদের কালবেলাকে বলেন, হৃদয়বিদারক এ ঘটনায় সমগ্র ফটিকছড়ি শোকস্তব্ধ। চোর সন্দেহে মাহিন এবং তার দুই বন্ধুকে পেটানো হলেও আসল রহস্য কী, তা খুঁজে বের করা জরুরি।
ফটিকছড়ি থানার ওসি নুর আহমদ কালবেলাকে বলেন, ঘটনার খবর শুনে পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার ও তাৎক্ষণিক দুজনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেহেতু হতাহত এবং ঘাতকরা একই ইউনিয়নের বাসিন্দা আর পরিচিতমুখ, কিশোরদের কী কারণে এভাবে পেটানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দোষীরা ছাড় পাবে না।
‘মব’ সৃষ্টি করে কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার খবর শুনে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) নজরুল ইসলামসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা শুক্রবার বিকেলেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সে সময় ইউএনও সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় দোষীদের ছাড় দেওয়া হবে না। দুজন গ্রেপ্তার হয়েছে, বাকিদেরও খুঁজে বের করা হবে। রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে আছে, মব সৃষ্টি করে কেউ পার পাবে না।