Image description

সাদা আর কালো টাকার সম্পদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এখন দেশের ব্যাংক লকারগুলো। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে লক্ষাধিক লকারে কে কী রাখছেন, কত টাকার বৈধ-অবৈধ সম্পদ রয়েছে-এসবের কোনো ধারণা নেই রক্ষকদের। বৈধভাবে ভাড়া নিয়ে অবৈধ কিছু রাখা হলেও এসব খতিয়ে দেখার অধিকার নেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। লকারে কোটি টাকার সম্পদ রাখলে যেমন কোনো জবাবদিহি নেই, তেমনি এ সম্পদ চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দায় নেই ব্যাংকের।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক লকারের জন্য সময়োপযোগী নীতিমালা দরকার। তাদের দাবি, লকার নিয়ে সঠিক নীতিমালা ও সুস্পষ্ট আইন না থাকায় কালো টাকার মালিকদের অনেকেই সম্পদের বিশাল একটি অংশ লুকিয়ে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন, যা মূল অর্থনীতির হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। গৃহিণীদের ব্যবহৃত স্বর্ণ, বিভিন্ন গহনা বা ফ্ল্যাট-বাড়ির দলিল ব্যাংক লকারে রাখার স্বাভাবিক রীতি হলেও সন্দেহজনক লকার খুলে পাওয়া যাচ্ছে কাড়িকাড়ি ডলার-পাউন্ড, স্বর্ণের বারসহ বৈধ-অবৈধ সম্পদের বিশাল মজুত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে লকার ব্যবহার হলেও ২০২৩ সালে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেলে ব্যাংক লকার সবার নজরে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক অভিযানে বিভিন্ন ব্যাংকের লকার থেকে অঘোষিত অর্থ, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধারের তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের লকারে তল্লাশি চালিয়ে সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরীর রাখা ৫৫ হাজার ইউরো এবং এক লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়। পাশাপাশি ৭০ লাখ টাকার এফডিআর ও প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের এক কেজি (প্রায় ৮৬ ভরি) সোনার অলংকার জব্দ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাকাউন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে গ্রাহকের জবাবদিহির বিষয়টি থাকে। এক্ষেত্রে তার আয়কর বিবরণী জমা দেওয়া অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। কিন্তু লকার ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর এ সুযোগ অনেকে কাজে লাগাতে পারেন তাদের কালো টাকার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, লকার ব্যবহার করা হয় মূল্যবান সম্পদ রাখার জন্য। যদি কেউ অবৈধ কিছু রাখে, তার দায়ভার ব্যক্তির নিজেরই। এখানে ব্যাংকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আর এটা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি ব্যবসা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।

আরিফ হোসেন খান আরো বলেন, ব্যাংকে যারা আমানত রাখেন, তারা বৈধ-অবৈধ আয় সবই রাখেন। এখন যদি বৈধ আয়টুকুই কেউ ব্যাংকে রাখতেন, তাহলে এত অ্যাকাউন্ট জব্দ হতো না। তেমনি লকারে কে কী রাখেন, সেটা একান্তই তার দায়ভার। তিনি জানান, লকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন একটি নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিগগির বাংলাদেশ ব্যাংক এটি সার্কুলার আকারে প্রকাশ করবে।

নতুন নীতিমালায় লকার কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে, তা নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করবে ব্যাংকগুলো। লকার স্থাপনের জন্য ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। অবৈধ ও বিস্ফোরকজাতীয় কিছু রাখা যাবে না। যদি কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকের সন্দেহ হয়, তখন ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়া লকার ফি কত হবে, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণও ঠিক করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যাতে গ্রাহক হয়রানির শিকার না হন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, সাধারণ ব্যাংকিং সেবার মতো লকার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিদরকার। লকার ব্যবহারে সবপর্যায়ে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদের আইনগতভাবে বৈধ উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার কথাও বলেন তিনি। ‘নো ইওর কাস্টমার’ (কেওয়াইসি) পদ্ধতি চালু হলে কালো টাকা বা অবৈধ সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার সুযোগ আর থাকবে না। এতে মূল অর্থনীতিতে সম্পদের সব হিসাব চলে আসবে, দুর্নীতির সুযোগও কমে যাবে। একই ভাবে লকারে রাখা অর্থ-সম্পদের হালনাগাদ বিবরণী বার্ষিক আয়কর রিটার্নের অংশ হিসেবে নিয়মিত নজরদারির আওতায় আনার দাবি জানান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দেশে লকারের সংখ্যা কত, কত ভাড়া

বর্তমানে দেশে কতটি ব্যাংক লকার চালু আছে, তার কোনো কেন্দ্রীয় রেকর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই। তবে ৬১টি ব্যাংকের প্রায় সবগুলোতেই লকারব্যবস্থা চালু আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমাননির্ভর তথ্যানুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ লকার থাকতে পারে। ব্যাংকগুলো স্বতন্ত্রভাবে এসব লকার পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কোনো তদারক বা পরিদর্শনব্যবস্থা এক্ষেত্রে নেই। তবে লকার অ্যাকাউন্ট খোলার সময় গ্রাহকের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারনামা রাখা হয়।

লকার ভাড়া নিয়েও সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা নেই। একেক ব্যাংক একেকরকম ভাড়া আদায় করে। যেমন সোনালী ব্যাংকের ৫৪টি শাখায় লকার সুবিধা চালু আছে। সেখানে ছোট লকারের বার্ষিক ভাড়া দুই হাজার টাকা, মাঝারি লকারের ভাড়া দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং বড় লকারের জন্য ভাড়া তিন হাজার টাকা নির্ধারিত। আইএফআইসি ব্যাংকে ছোট লকারের ভাড়া পাঁচ হাজার, মাঝারি ১০ হাজার এবং বড় লকারের জন্য ১২ হাজার টাকা। সিটি ব্যাংকে রয়েছে প্রায় চার হাজার লকার। তাদের ছোট লকারের জন্য ভাড়া পাঁচহাজার, মাঝারি সাত হাজার এবং বড় লকারের জন্য ৯ হাজার টাকা। বড় লকারের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে জানা গেছে।

কী আছে লকারে, জানার সুযোগ নেই রক্ষকের

বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী ব্যাংক লকারের ভেতর গ্রাহক কী রাখছেন, সে তথ্য জানার অধিকার নেই রক্ষক বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের। তবে প্রতিবার লকার খোলার সময় গ্রাহককে সই-স্বাক্ষরের মাধ্যমে মালিকানা প্রমাণ দিয়ে লকারের জিনিস বের করা বা নতুন জিনিস সংরক্ষণের সুযোগ থাকে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিটি লকারের দুটি চাবি থাকেÑএকটি গ্রাহকের কাছে, অন্যটি ব্যাংকের কাছে। গ্রাহকের উপস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তা একত্রে চাবি ব্যবহার করে লকার খুলে দেন। তবে লকার খোলার সময় সেখানে কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন না। গ্রাহক কী রাখছেন, তা ব্যাংক জানে না।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সামসুদ্দোহা আমার দেশকে জানান, তার ব্যাংকের লকার ব্যবহারের চুক্তিতে বলা আছে—লকারে বিস্ফোরকদ্রব্য, অবৈধ পণ্য বা নিষিদ্ধ বস্তু রাখা যাবে না। তবে এসব বিষয়ে নজরদারির ব্যবস্থা নেই। লকারের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রাহকের। সেখানে ব্যাংকের কেউ উপস্থিত থাকেন না। কেউ যদি অবৈধ কিছু রাখেন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতের অনুমতি নিয়ে লকার খুলতে পারে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে লকার তল্লাশির ক্ষমতা দুদক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রয়েছে।

সামসুদ্দোহা জানান, ২০২৩ সালেই তার দেখা সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল লকারের। সে বছর একরকম হিড়িক পড়ে গিয়েছিল লকার ভাড়া নেওয়ার। সে সময় ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী লকার দিতে পারেনি। তবে এখন আবার চাহিদা খুব একটা নেই।

সম্পদ চুরি হলেও ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেই

গত বছরের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখায় যান ব্যাংকটির গ্রাহক রোকেয়া আকতার বারী। এ শাখায় তার মেয়ে নাসিয়া মারজুকার সঙ্গে যৌথভাবে একটি লকার ভাড়া নেওয়া ছিল।সে সময় লকারটির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন লকার কক্ষের দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। ব্যাংক কর্মকর্তা লেজার বইয়ে স্বাক্ষরের পর কক্ষ খুলে দেন। কিন্তু রোকেয়া দেখতে পান তার লকারটি আগে থেকেই খোলা। তিনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানান, সেখানে তার ১৪৯ ভরি সোনার গহনা ছিল। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দেয়—এ নিয়ে তাদের কিছুই করার নেই।

পরে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার করেও কোনো লাভ হয়নি রোকেয়ার। কয়েক দিন পর ৩ জুন তিনি চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় মামলা করতে যান। পুলিশ মামলা না নিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লিপিবদ্ধ করে।

দৈনিক আমার দেশ সে সময় দায়ের করা জিডির একটি কপি সংগ্রহ করেছে। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের ভেতরে অত্যন্ত সংরক্ষিত স্থানে রাখা লকার তিনি খোলা দেখতে পান। লকারের দুটি চাবির একটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল এবং অন্যটি তার হাতে। ওই লকারে স্বর্ণের ৪০টি হাতের চুড়ি, চারটি জড়োয়া সেট, একটি গলার সেট, সাতটি চেইন, ২৫টি আংটি এবং ৩০ জোড়া কানের দুল ছিল। এসবই খোয়া যাওয়ার অভিযোগ আনেন বাদী।

জিডিতে বিবাদী করা হয় ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, ব্যাংক সচিব কেকিউএম হাবিবউল্লাহ, শাখা ম্যানেজার এসএম শফিকুল মাওলা চৌধুরী ও লকারটির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইউনুসকে।

আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে অভিযোগকারী রোকেয়ার সঙ্গেযোগাযোগ করা হয়। তবে বয়সে বৃদ্ধা এই লকারের গ্রাহক কথা বলতে পারেননি। কথা বলেছেন তার ছেলে চিকিৎসক রিয়াদ মোহাম্মদ মারজুক। তিনি বলেন, ‘আমার মা বয়সের ভারে চলাফেরা করতে পারেন না। তিনি স্বর্ণ চুরির পর আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তিনি সত্যিই ক্লান্ত।’

মারজুক জানান, তারা এ নিয়ে মাসের পর মাস বিভিন্ন জায়গায় ধরনাদিচ্ছেন কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এখন চুরি যাওয়া এসব স্বর্ণের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। কয়েক মাস আগে একবার তিনি নিজে দুদকে অভিযোগ করলে চট্টগ্রামে দুদকের স্থানীয় কার্যালয়ে তার মাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু এখানেই শেষ, কেউ আর এ নিয়ে কিছু জানায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ নিয়ে কথা হয় ইসলামী ব্যাংকের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের সঙ্গে। তিনি আমার দেশকে জানান, এ নিয়ে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ একাধিকবার আলোচনা করেছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে এর আসল রহস্য বের করার চেষ্টা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংক লকার থেকে স্বর্ণালংকার উধাও হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক থেকে গ্রাহক যে লকার সেবাটি নেন, সেটি অন্য কেউ খুলতে পারার কথা নয়।

নিরাপত্তার দুর্বলতা কোথায়

বেসরকারি একটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ সরফুদ্দিন ব্যাংক লকারের নিরাপত্তার দুর্বলতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি জানান, লকারের নিরাপত্তা দুই স্তরবিশিষ্ট। একটি চাবি থাকবে ব্যাংকের কাছে, অন্যটি গ্রাহকের কাছে। কিন্তু ভাড়া দেওয়ার বা নেওয়ার আগ পর্যন্ত দুটি চাবিই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকে। তখন তিনি চাইলেই গ্রাহকের চাবির একটি নকল কপি তৈরি করে রাখার সুযোগ পান। একই ভাবে কোনো গ্রাহক যদি পেশায় তালাচাবি তৈরির কারিগর হন, তিনি চাইলেই বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে অন্য লকারের মালামাল লুটে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সব লকারের ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি ম্যানুয়াল ও ডিজিটাল ব্যবস্থা চালুর কথা বলেন এই ব্যাংকার।

ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে শেখ সরফুদ্দিন জানান, বিদ্যমান আইনে ছোট লকারের বিপরীতে গ্রাহক সর্বোচ্চ এক লাখ, মাঝারি লকারে দুই লাখ এবং বড় লকারে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। শেখ সরফুদ্দিন ২০২৩ সালে হঠাৎ চাহিদা বাড়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ওই সময় তার শাখায় লকারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল। ওই বছরের নভেম্বরে তার কাছে অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন গ্রাহক আসেন লকার পাওয়ার আশায়। তাদের সবাই এই ব্যাংকেরই পুরোনো গ্রাহক।

গ্রাহকদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় ছিল কি নাÑজানতে চাইলে সরফুদ্দিন বলেন, তাদের দুয়েকজন ব্যবসায়ী এবং বহু বছর ধরেই একই শাখায় লেনদেন করছেন। কিন্তু হঠাৎ কেন তাদের লকারেরপ্রয়োজন হয়েছিল, সে বিষয়টি তখন তিনি আর জানতে চাননি।

ব্যাংক, বিমা ও কোম্পানি নিয়ে কাজ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীনাজমুল কবির। ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদ চুরি বা হারিয়ে গেলে বা গ্রাহকের অজান্তে কেউ তুলে নিলে তার প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এ ব্যাংকের কার্যাবলির একটি ধারায় গচ্ছিত বস্তুর নিরাপত্তার জন্য ভল্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এ আইনের কোথাও গচ্ছিত বস্তুর ক্ষতিসাধন হলে কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সে কথা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু যদি ব্যাংকটির অবসায়ন হয়, সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমানত বিমা আইন কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। বিমার পরিমাণ এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বলেও জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রয়েছে আলাদা লকার

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্য পৃথকভাবে লকার সুবিধা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে স্থাপিত এসব লকারে ব্যাংকের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তারা তাদের নথিপত্র বা মূল্যবান সম্পদ রাখতে পারবেন। এসব লকার ২০ বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য। নির্ধারিত সময়ের পর লকার যদি অদাবিকৃত থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা খুলে সম্পদ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দৈনিক আমার দেশকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লকার সুবিধা শিগগির বাতিল করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তিনি আরো জানান, কেউ যদি লকারের অপব্যবহার করে, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। শিগগির এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

লকারের আদি ইতিহাস

মিসর, ব্যাবিলন, গ্রিস, তুরস্ক ও রোমে ধনসম্পদ রাখার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রায় চার হাজার বছর আগে নিরাপদ কক্ষের ধারণা প্রথম দেখা যায়। পরে মধ্যযুগে ইউরোপের গোল্ডস্মিথরা আধুনিক ব্যাংক লকারের আদলে নিরাপদ বাক্স সরবরাহ শুরু করেন। আধুনিক অর্থে ব্যাংক লকার সেবার সূচনা হয় ১৭ শতকে ইংল্যান্ডে। এরপর ১৯ ও ২০ শতকে এটি উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বাংলাদেশে কবে থেকে চালু হয়

বাংলাদেশে ব্যাংক লকার ব্যবস্থার ইতিহাস শুরু হয় ব্রিটিশ ভারতের সময়, তবে সীমিত পরিসরে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সোনালী, জনতা, রূপালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ধাপে ধাপে এ সেবা চালু করে। ১৯৮০-এর দশকের পর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উত্থানে লকার সুবিধার প্রসার ঘটে; বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের মতো শহরে।

বর্তমানে প্রায় প্রতিটি প্রধান ব্যাংকের নির্বাচিত শাখায় লকার সুবিধা রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় লকার কম হওয়ায় গ্রাহকদের তালিকাভুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। গ্রাহকরা সাধারণত বার্ষিক ফি দিয়ে লকার ভাড়া করে থাকেন, যেখানে তারা স্বর্ণালংকার, দলিলপত্র ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষণ করেন।

ব্যাংক লকারে কালো সম্পদের ছায়া

ব্যাংকের সেফ-ডিপোজিট লকার দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপদ সম্পদ সংরক্ষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। মূল্যবান স্বর্ণ, জমির দলিল, পারিবারিক ঐতিহ্য কিংবা গোপনীয় নথিপত্র—সবকিছুই রাখা হয় বিশেষ এই ভল্টে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসব লকারে কালো সম্পদ সংরক্ষণের প্রবণতা ও নীতিমালার অভাব নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বর্তমানে ব্যাংক লকার ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু প্রাথমিক নির্দেশনা থাকলেও কালো সম্পদ সংরক্ষণ ঠেকাতে কার্যকর কোনো আইন বা মনিটরিং কাঠামো নেই। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া লকার খুলতে পারে না আবার তারা জানেও না ভেতরে কী আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুধু লকার ভাড়া দেই। ভেতরে কী আছে, সেটি দেখা আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না। তবে আমরা সন্দেহজনক লেনদেন হলে রিপোর্ট করি। এ সুযোগকেই ব্যবহার করছেন কিছু অসাধু ব্যক্তি—ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না রেখে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ, নগদ অর্থ বা বিদেশি মুদ্রা সরাসরি লকারে রাখছেন, যা আয়কর বা মানি লন্ডারিং আইনের পরিপন্থী।’

লেনদেনহীন অ্যাকাউন্টের সম্পদ যাবে সরকারের তহবিলে

লকার নিয়ে স্ব স্ব ব্যাংক গ্রাহকদের স্বাক্ষরসহ কিছু শর্ত মেনে চলার অঙ্গীকার নিয়ে থাকে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরোনো কিছু নীতিমালা মেনে লকারব্যবস্থা পরিচালনা করে অনেক ব্যাংক।সবশেষ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের জন্য একটি সার্কুলার জারি করে। এতে অদাবিকৃত আমানত ও মূল্যবান সামগ্রী সরকারি তহবিলে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৩৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনো অ্যাকাউন্টে টানা ১০ বছর লেনদেন বা যোগাযোগ না থাকলে সেটি ‘অদাবিকৃত’ হিসেবে বিবেচিত হবে। একই নিয়ম প্রযোজ্য চেক, ড্রাফট, এক্সচেঞ্জ বিল ও ব্যাংকের জিম্মায় লকারে থাকা মূল্যবান সামগ্রীর ক্ষেত্রেও।

নির্দেশনা অনুযায়ী, এ ধরনের অদাবিকৃত অর্থ বা সম্পদের দাবিদারকে তিন মাসের মধ্যে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে নোটিস দিতে হবে।নোটিস পাঠানোর তিন মাস পরও যদি কোনো সাড়া না আসে, তাহলে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত ফরমে ওই অর্থ ও সম্পদের বিবরণ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে জমা দিতে হবে।

অদাবিকৃত টাকার ক্ষেত্রে দেশীয় মুদ্রা সুদসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে এবং বৈদেশিক মুদ্রা নির্ধারিত ছয়টি মুদ্রায়Ñডলার, পাউন্ড, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ইয়েন ও কানাডিয়ান ডলারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। অন্য মুদ্রায় জমা দিতে হলে সেটিকে ডলারে রূপান্তর করে পে-অর্ডার দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে কোনো গ্রাহক বা উত্তরাধিকারী দাবি করলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করে অর্থ বা সম্পদ ফেরত নিতে পারবেন। মৃত গ্রাহকের ক্ষেত্রে নমিনি না থাকলে উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার সনদ ও পরিচয়পত্রসহ আবেদন করতে হবে। দুই বছর পার হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন থাকা এসব অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী সরকারের তহবিলে স্থানান্তর করা হবে এবং পরে এসবের ওপর আর কোনো দাবি গ্রহণযোগ্য হবে না।

লকার গ্রাহক ও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, লকারব্যবস্থা নিয়ে একটি দিকনির্দেশনা খুবই জরুরি। দিনদিন লকারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো যেমন মুনাফার একটি অংশ করতে পারে, তেমনি প্রকৃত অর্থে যারা নিরাপত্তাহীনতার কথা মাথায় রাখেন, তাদের জন্য লকার একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হতে পারে।