Image description

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েক মাস নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এমনকি গত রোজায়ও দ্রব্যমূল্যের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়নি, যা সরকারের জন্য প্রশংসাও বয়ে আনে। সম্প্রতি খাদ্যদ্রব্যের দাম আবারও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। একটি বড় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলেছে, এ বৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি। প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এবং সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের তৈরি ‘মেকানিজমের’ কারণেই বাজার প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে বিপাকে পড়ছেন। দাম বৃদ্ধির জন্য সাধারণভাবে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজিকে দায়ী করা হলেও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আসল কলকাঠি নাড়ছে মধ্যস্বত্বভোগীরাই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দ্রব্যমূল্য কখনোই স্থিতিশীল হবে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যই সবকিছুর দাম বেড়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে এক গ্রুপকে চাঁদা দিতাম, এখন তিনটি গ্রুপকে দিতে হয়। বিএনপি, এনসিপি আর জামায়াত—এই তিন গ্রুপ। আগে পরিবহনে চাঁদাবাজি হতো, তা এখনো চলছে। আড়তদার বা বেপারি কোনো উৎপাদন বা আমদানিতে জড়িত না থেকেও দাদন খাচ্ছে। এখন তারা কমিশন এজেন্টে পরিণত হয়েছে। কত টাকা দিয়ে কিনেছে তার কোনো পাকা রসিদ থাকে না, প্রতি কেজিতে শুধু কমিশন নেয়। করপোরেট গ্রুপগুলো দাদন দিয়ে কমিশনের মাধ্যমে চাষাবাদ করাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমান উপদেষ্টাও এসব অনিয়মের বিপক্ষে, কারণ তার নিজেরও ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশের ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে, ফলে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। এজন্য আমরা আলাদা ভোক্তা মন্ত্রণালয়ের দাবি তুলেছিলাম। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। আমাদের বাজারে এসব অনিয়ম এখন নিত্যদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছে।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি তদন্ত করতে তারা দেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকারী জেলা ও বন্দর থেকে ঢাকার বাজার পর্যন্ত অনুসন্ধান চালান। সবজির জন্য বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার নিমসার, নরসিংদীর জংলী বাজার ও যশোরের সাতমাইল; চালের জন্য দিনাজপুর, শেরপুর ও নওগাঁ; দেশি পেঁয়াজের জন্য পাবনা এবং আমদানিকৃত পণ্যের জন্য চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও যশোরের বেনাপোল থেকে পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রীবেশে ঢাকার বিভিন্ন বাজার পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

অনুসন্ধানে কৃষকের উৎপাদনমূল্য, স্থানীয় বাজারদর, পরিবহন খরচ, ঢাকা আড়তের পাইকারি দাম, প্যাকেজিং, শ্রম, কমিশন এবং চাঁদাবাজি-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে প্রত্যক্ষভাবে চাঁদাবাজির প্রমাণ না মিললেও ট্রাক ভাড়া নিতে স্ট্যান্ডে নানা ধরনের দালালির তথ্য পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাধারণ মানুষ ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকার রাজনৈতিক নয়, তাই কে অসন্তুষ্ট হলো বা কে সন্তুষ্ট হলো—তা না দেখে মধ্যস্বত্বভোগীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এই চক্র মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। এতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকাংশ ট্রাক অনুমোদিত ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ মাল বহন করে। সিটি করপোরেশনের চাঁদা, পার্কিং ফি বা মালিক-শ্রমিক সমিতির চাঁদা খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দামে বড় প্রভাব ফেলে না। দাম বাড়ানোর মূল কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি। তাদের হাতেই খুচরা বাজারে দাম দ্বিগুণ এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। উৎপাদনকারী ও ভোক্তা—উভয়কেই বঞ্চিত করে এই চক্র বছরের পর বছর মুনাফা লুটে আসছে, অথচ কোনো সরকারই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সবজি, চাল, ডাল ও পেঁয়াজ আনতে হলে পথে পথে নানা নামে আট জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। যদিও এই চাঁদার পরিমাণ খুব বেশি নয়; কিন্তু ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে চাঁদাবাজিকেই বেশি দায়ী করেন। আসলে নিজেদের কারসাজি ঢাকতেই তারা বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। তাদের এই কারসাজির কারণে অনেক সময় খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে দামের পার্থক্য কিছু সবজির ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়।

কারওয়ান বাজারে প্রবেশ করতে খাদ্যপণ্যবাহী প্রতি ট্রাকে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ১০০ টাকা দিতে হয়। ট্রাক পার্কিং খরচ (যা ইজারা ছাড়া আদায় করা হয়) ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বাজার খাজনা ৪০০ টাকা। ট্রাকের দালালরা নেয় ১ হাজার টাকা। ট্রাক শ্রমিক সমিতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা, ট্রাক মালিক সমিতি ৫০ টাকা, বাজার কমিটি ১৬০ টাকা এবং সুইপার চাঁদা গাড়ি প্রতি ২০০ টাকা নেয়। তবে কিছু জায়গায় মালিক সমিতির চাঁদা নেওয়া হয় না।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার কারওয়ান বাজারে শ্রমিক, ভ্যানচালক, আড়তদার ও লাইনম্যানদের যোগসাজশে পাইকারদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা নেওয়া হয়। সড়কে পুলিশের চাঁদাবাজির সুস্পষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরও জানা যায়, দেশের প্রায় সব জেলায় সবজি উৎপাদন হলেও প্রতিটি জেলায় আড়ত না থাকায় কৃষক ও ফড়িয়াদের অন্য জেলার আড়তে গিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয়। এতে তাদের অতিরিক্ত খরচ হয় এবং সবজির দাম বাড়ে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্যপণ্য সরবরাহের ১০টি রুটে ট্রাকে যাত্রীবেশে ভ্রমণ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাদের ভ্রমণে সড়ক-মহাসড়কে জেলা পুলিশ বা হাইওয়ে পুলিশের কোনো ধরনের নিয়মিত চাঁদাবাজি বা অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ট্রাক মালিক সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, খাদ্যপণ্য পরিবহনের জন্য পুলিশের সঙ্গে মাসিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক কোনো চুক্তি নেই। তবে যেসব ট্রাকে হালনাগাদ কাগজপত্র নেই এবং নিয়মিত অতিরিক্ত মাল বহন করে, সেই ট্রাক মালিকরা হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ফলে কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ব্যক্তিগত লাভের আশায় মামলার ভয় দেখিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে টাকা আদায় করেন।

কর্মকর্তারা জানান, দেশের আট বিভাগের পরিবহন শ্রমিকরা তাদের জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর মামলার নামে হয়রানি করা বা সাধারণ মানুষের গাড়ি থামিয়ে চাঁদা নেওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমত, সড়কে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, কারওয়ান বাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে মধ্যস্বত্বভোগী এবং সিন্ডিকেটের অনিয়ম ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত, যেসব জেলায় সবজির উৎপাদন বেশি, সেখানে আড়ত স্থাপন করতে হবে এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় হাতবদল কমিয়ে সবজির দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।