
আশুগঞ্জ আতঙ্ক ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে। আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত ১২ দশমিক ২১ কিলোমিটার রাস্তাতেই থমকে যাচ্ছে সব যানবাহন। আসা যাওয়ার পথে এই ১২ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে যাচ্ছে ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। যানজটের ভয়ংকর থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না অ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও। অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়ছেন সিলেট বিভাগের সব জেলাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী যাত্রীরাও। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার অনুমোদিত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নকশা জানার পরও আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের রহস্যময় ভূমিকার কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই দুর্ভোগ।
জানা গেছে, ২০২০ সালে অনুমোদন পাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নকশায় ছিল চার লেন এবং এসএমবিসি ৫.৫ ফুট। তবে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কে ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার সড়কের নকশায় ছিল চার লেন এবং ৩.৬ ফুট এসএমবিসি। এরপরও আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের নির্মাণের সঙ্গে জড়িতরা তাদের প্যাকেজ-১ এর (আশুগঞ্জ-বিশ্বরোড) রাস্তা নির্মাণে কোনো পরিবর্তন আনেননি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে টানা পাঁচ বছর। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পাঁচ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুন মাসে। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের খরচ ছিল প্রায় ১১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৫৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত বছর আগস্টে সরকার পতনের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এফকন’-এর ভারতীয় কর্মীরা নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশে ফিরে যান। তবে নভেম্বরে তারা কাজে ফিরলেও কাজ ছিল কচ্ছপ গতির। এর মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে আরও দুই বছরের সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক আবদুল আওয়াল মোল্ল্যা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নকশার বিষয়টি অবগত হয়ে তারা অর্থদাতা প্রতিষ্ঠন ‘এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’কে অবহিত করেছিলেন। ১৯ মাস পর আমরা সেই পত্রের উত্তর পেয়েছি। এর মধ্যে ডিপিপি রিভাইজ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গতকালও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। শিগগিরই এই প্যাকেজ-১ এর কাজ শুরু হবে। আমরা আশা করছি আগামী এক বছরের মধ্যে এই ১২ কিমি এর কাজ শেষ করতে পারব। এ ছাড়া প্যাকেজ-৩ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া) প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এজন্য আগের প্রাক্কলিত অর্থ থেকে ৬০০ কোটি টাকা ফেরত যাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেন এবং কী কারণে আশুগঞ্জ-আখাউড়ার ৫০ কিমি. সড়কের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল- তা সবাই জানে। ঠিকাদার, সরবরাহকারীসহ ৭৫ শতাংশ ভারত থেকে নেওয়া লাগবে- সেই শর্ত আমরা মেনেছিলাম। অথচ ট্যারিফ এবং টোল থেকে কী পরিমাণ সুবিধা আদায় করা যাবে- তা যথাযথ বিশ্লেষণ করা হয়নি। তাই ইআরডির উচিত হবে- ভবিষ্যতে দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে কোনো চুক্তিতে যাওয়া।
এ বিষয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, কেবলমাত্র ভারতের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ভারতে এক কিলোমিটার রাস্তায় সর্বোচ্চ খরচ হয় ১৪ কোটি টাকা। আর আমাদের দেশের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। তারপরও ৬ বছরেও ১২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শেষ হয় না? তিনি আরও বলেন, খানাখন্দে ভরা এই রাস্তার কারণে আমাদের প্রচুর যানবাহন বিকল হয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। নষ্ট হচ্ছে অর্থ এবং সময়। বাস্তবায়নকারী কতৃপক্ষের কাছে এর জবাব চাওয়া উচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত ১৩ আগস্ট রাত আড়াইটা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত পার হতে যানবাহনগুলোর লেগেছিল ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। এ সময়ে আশুগঞ্জ থেকে ঢাকার দিকে ১০ কিলোমিটার এবং সরাইল বিশ্বরোড থেকে শাহবাজপুর পেরিয়ে ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে জানা যায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী একটি বালুবাহী ট্রাক রাত আড়াইটার দিকে সরাইল বিশ্বরোড থেকে এক কিলোমিটার এগিয়ে গর্তে পড়ে বিকল হয়ে যাওয়ার কারণে এই যানজটের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ ওই যানজটে আটকে থাকায় বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী, চালক ও তাঁদের সহকারীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। সরাইলে আটকে পড়াদের মধ্যে ছিল একটি অ্যাম্বুলেন্স। গুরুতর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের বাসিন্দা আবদুল মাবুদ। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে তাকে ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। টানা ৫ ঘণ্টা এই সড়কে আটকে ছিলেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই এই মহাসড়কে চলাচলের দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যায়। সড়কের ছোট-বড় গর্তে পানি জমে, শুষ্ক মৌসুমে ওড়ে ধুলা। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, বিকল হচ্ছে গাড়ি। এর বাইরেও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী অংশের মাহমুদাবাদ থেকে মাধবদী পর্যন্ত প্রায় ৫৪ কিলোমিটার অংশে অন্তত ৫০টি স্থানে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এই মহাসড়ককে সাময়িকভাবে চলাচলের উপযোগী করতে এসব স্থানে সংস্কারকাজ চলছে। এর ফলে ধীরগতিতে চলছে যানবাহন, ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা।