Image description
দলগুলোর মতপার্থক্য » প্রত্যাশা ছিল আগস্টের শুরুতেই চূড়ান্ত হবে । » ৬ দল মত দিয়েছে , সময় চেয়েছে ৫ টি । » ২২ আগস্টের মধ্যে মত দেওয়ার অনুরোধ । » অনিশ্চয়তা দেখছি না : আলী রীয়াজ

২০২৪ সালের জুলাই - আগস্ট গণ- আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ ; যার মধ্যে প্রতিফলিত হবে আন্দোলনের মূল চেতনা ও অঙ্গীকার । মতানৈক্যসহ নানা কারণে তা বিলম্বিত হলেও শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল ও সমমনা সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা ও দাবি ছিল আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে আগস্টের প্রথম দিকে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাবে । কিন্তু জাতীয় সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো মতবিরোধ রয়ে যাওয়ায় আগস্ট মাসের মধ্যে এর ফয়সালা হবে কি না , তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা । এ অবস্থায় বিষয়টির সুরাহার জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ।

বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ( এনসিপি ) বিভিন্ন দল সনদের খসড়ার কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে নিজ নিজ আপত্তির কথা জানিয়েছে । ঐকমত্য কমিশন এখন তাদের সুনির্দিষ্ট অভিমত জানার অপেক্ষায় রয়েছে । দলগুলোর মতবিরোধের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন , বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর মন্তব্য বিবেচনায় নিলে তো বিষয়টা দুরূহ হয়ে পড়বে । উনারা ( দলগুলো ) লিখিত মতামত দিলে আমরা বিবেচনা করব । '

তিনি বলেন , রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি । মতামত এলে কমিশন এবং কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সেগুলো সমন্বয় করার পর সার্বিক বিষয়টি বিবেচনা করা হবে । তবে অগ্রগতি দৃশ্যত ধীর হলেওজুলাই সনদ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছেন না আলী রীয়াজ । তিনি বলেন , ' আমি এখন পর্যন্ত কোনো অনিশ্চয়তা দেখছি না । প্রক্রিয়া তো চলছে , প্রক্রিয়া তো বন্ধ হয়নি ।'

আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘আমরা আশা করছি এই সপ্তাহে না হলেও আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে বসব । তারা যত দ্রুত মতামত দেবে , তত তাড়াতাড়ি পর্যালোচনা করে তার ভিত্তিতে আলোচনা সম্ভব হবে । ' রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া চূড়ান্ত করে ১৬ আগস্ট মতামতের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ।

গতকাল বুধবার বিকেল ৪ টার মধ্যে মতামত জমা দিতে বলেছিল কমিশন । তবে এ সময়ের  মধ্যে শুধু বিএনপি , এবি পার্টি , বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস , এনডিএম , জাতীয় গণফ্রন্ট আমজনতার দল মতামত জমা দিয়েছে । জামায়াতে ইসলামী , জাতীয় নাগরিক পার্টি ( এনসিপি ) মতামত দেয়নি । পাঁচটি দল আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত জমা দিতে সময় চেয়েছে । সেগুলো হচ্ছে সিপিবি , গণফোরাম , বাংলাদেশ জাসদ , বাসদ , বাসদ - মার্কসবাদী । গতকাল বিকেলে কমিশনের পক্ষ থেকে বাকি সব দলকে ২২ আগস্ট শুক্রবারের মধ্যে তাদের মত জমা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে । জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি সময় চায়নি । তবে এরাসহ সবার সঙ্গেই কমিশনের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রয়েছে ।

বিশেষ করে সনদের অঙ্গীকারনামার কিছু ধারা নিয়ে দলগুলোর বিভিন্ন আপত্তি রয়েছে । বিএনপি ও সমমনারা জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দিতে চায় না । বামদলগুলোও এ বিষয়ে আপত্তি জানাবে বলে জানা গেছে । অন্যদিকে এনসিপি জুলাই সনদের বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা চায় । সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়ার বিষয়ে জামায়াতের আপত্তি নেই । দলটি বলছে , সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জনগণের অভিপ্রায় সংবিধানের ওপরে । সনদের সমন্বিত খসড়ার কয়েকটি বিষয় নিয়ে আপত্তি বিএনপির । দলটি মনে করে , কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে না । জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে খারাপ নজির তৈরি হবে । এ নিয়ে গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনার পর খসড়া পর্যালোচনা করে গতকাল মতামত জমা দিয়েছে বিএনপি ।

দলটির সূত্র বলছে , কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকলেও ছাড় দেওয়ারও চিন্তা আছে বিএনপির । নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপির এই চিন্তা বলে জানিয়েছে সূত্রটি । সনদ নিয়ে বিএনপির ‘ ইতিবাচক ’ অবস্থানের কথা জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন , জুলাই সনদের অঙ্গীকার রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল বিধায় তা সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে না । তবে আলোচনার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে আইনি , বৈধ এবং সাংবিধানিক উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব বলে বিএনপি বিশ্বাস করে । জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নেও আশাবাদী বিএনপি । এর আগে গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সনদের চূড়ান্ত খসড়া সূচনা ও ২ , ৩ এবং ৪ নম্বর দফা নিয়ে বিএনপির আপত্তির কথা জানান সালাহউদ্দিন আহমদ ।

তিনি তখন বলেন , ' কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা না হলেও তা সেখানে রাখা হয়েছে । এ ছাড়া কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি । ' সালাহউদ্দিন বলেন , ‘ জুলাই সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব দফায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে , সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে ; যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট এসেছে , সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কারবিষয়ক যেসব কথা এসেছে , তার বাস্তবায়ন কীভাবে হবে— এসবের নিষ্পত্তি জরুরি । ' জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছে , বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান / প্রস্তাব / সুপারিশই প্রাধান্য পাবে ।

এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'কোনো সমঝোতা দলিল কি ' সুপ্রা কনস্টিটিউশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট ' (সংবিধানেরও ওপরের দলিল) হতে পারে ? ... যদি বলা হয় , এ দলিলের সবকিছুই সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে , তাহলে ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ নজির সৃষ্টি হবে । পুরো জাতির জন্য একটি খারাপ নজির সৃষ্টি করা ঠিক হবে না । বিএনপির আরেকটি সূত্র বলছে , সনদের বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না- এ বিষয়টিতেও দলটির আপত্তি আছে । সনদের ঐকমত্য হওয়া যেসব বিষয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করতে হবে , তা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে করার পক্ষে দলটি । অন্যগুলো আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে তারা ।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলেছে , সনদের খসড়ার কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকলেও তারা এ নিয়ে আন্তরিক । সনদের আইনি ভিত্তি চায় জামায়াত । দুই - এক দিনের মধ্যেই খসড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মতামত জমা দেবে দলটি । জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ( জুলাই সনদ ) ঝুলে গেলে তো দেশের অকল্যাণ হবে । কাজেই এটা বাস্তবায়ন করতেই হবে । ... সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা থাকলে আমরা মনে করি তারা একে আইনী ভিত্তি দেবে । না হলে জনগণই তাদের অধিকার আদায়ে সরকারকে বাধ্য করবে । ’ এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন , ‘ বলা হয়েছে এই সরকার নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে । এখানে বাস্তবায়নযোগ্য বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট না । আমাদের দাবি হচ্ছে পুরো সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে । মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা না হলে আমরা স্বাক্ষর করব না । ’ মতামত জমা দেওয়ার পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এবি পাটি জানিয়েছে কমিশনে পাঠানো চূড়ান্ত মতামতে তারা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ।

বিজ্ঞপ্তিতে এবি পার্টি বলেছে , পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া ( সংশোধিত ) প্রস্তাবের প্রারম্ভিক বক্তব্য এবং অনুচ্ছেদ ১-৪ এ তাদের মতামতের অনেকাংশ প্রতিফলিত হয়েছে । এবি পার্টি প্রাথমিক অবস্থান পরিবর্তন করে দ্বি - কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে মত দিয়েছে । তবে তারা প্রস্তাব করেছে , উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ( পিআর ) নির্বাচনের পদ্ধতি প্রয়োগ না হলে নিম্নকক্ষে প্রাথমিকভাবে ১০০ আসনে তা চালু করা যেতে পারে ।