Image description
পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু হয়েছে চলতি সপ্তাহে। এটাকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন দিগন্ত হিসেবে দেখছে সরকার। নতুন পাইপলাইন প্রকল্প অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে চালু হলেও এটি ট্যাংকার শিল্প সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল সরবরাহের ফলে ট্যাংকার জাহাজগুলো এখন অনেকটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স এসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। এতে নৌপথে তেল পরিবহন কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হতে পারে। বিদ্যমান ১২০টি আন্তর্জাতিক মানের ট্যাংকার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বেকার হতে পারেন এই খাতে কাজ করা হাজারো শ্রমিক। নেতারা অনতিবিলম্বে ইতিপূর্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে জাহাজ মালিকদের ও শ্রমিক-কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণসহ এই সকল জাহাজের ব্যাপারে ভবিষ্যৎ করণীয়সহ সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করার কথা বলছেন। মালিকরা অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ঢাকায় পাইপলাইনে তেল সরবরাহের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় কমার পাশাপাশি সময়েরও সাশ্রয় হবে। কমবে তেল চুরিসহ সিস্টেম লস। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৬৯৮  দশমিক ৬৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রায় ৬ বছর পর পাম্পিংয়ের মাধ্যমে তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। এই পাইপলাইন দিয়ে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ডিপোতে প্রতিদিন পাঠানো হচ্ছে জ্বালানি তেল। বিপিসি বলছে, পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ৪ লাখ লিটারের  বেশি জ্বালানি তেল পাঠানো হবে। পূর্বে এ তেল পরিবহনে শতাধিক কোস্টাল টাংকার প্রয়োজন হতো এবং প্রতিটি ট্যাংকার লোডিং থেকে আন-লোডিং পর্যন্ত সময় লাগতো প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। পর্যায়ক্রমে বিপিসি’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েলকে এই পাইপলাইন দিয়ে তেল সরবরাহ করা হবে।

সূত্র মতে, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনের কাজটি ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহীত হয়। প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদলাইন ও ফতুল্লা পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতায় এবং করোনাকালে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। এর মধ্যে প্রকল্প ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। বাড়ে জমি অধিগ্রহণ খরচও। ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকার বেশি। গত ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। 

সংগঠনটির নেতাদের দাবি, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এসব জাহাজ নিয়ে আসে যেখানে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগই সবচেয়ে বেশি। সংগঠনটি বলছে, জ্বালানি তেল পরিবহনে চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন চালুর কারণে এই এসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত জাহাজগুলোর মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য বিপিসিতে বাৎসরিক ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। এর বিপরীতে ওই পাইপলাইন নির্মাণে বিপিসি কর্তৃক এরই মধ্যে খরচ করা হয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার বেশি। আর এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপিসিকে বছরে খরচ করতে হবে ৭৭৩ কোটি টাকা। যা কোনোভাবেই ব্যয় সাশ্রয়ী নয় এবং  রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আমিন ভূঁইয়া মানবজমিনকে জানান, প্রতিটি ট্যাংকার তৈরি করতে প্রায় ১৩.৫০ থেকে ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। আমরা আনুমানিক ৩০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন কর্তৃক ইস্যুকৃত লেটার অব ইনটেন্ট-এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ১২০টি অয়েল ট্যাংকার জাহাজ নির্মাণ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর অধীনস্থ তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি যথা-পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের তেল পরিবহন কাজে নিয়োজিত রয়েছি। 

বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত জাহাজের মাধ্যমে বার্ষিক আনুমানিক ২২ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয় এবং এর বিপরীতে কোনোরূপ বিনিয়োগ ব্যতীত বিপিসিকে শুধুমাত্র জাহাজ ভাড়া বাবদ বছরে ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু আমরা অতীব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম এই ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় ও অপচয় বন্ধের নামে বিগত ২০১৬ সালে বিপিসি কর্তৃক চট্টগ্রাম-ঢাকা জ্বালানি তেল পরিবহনে প্রায় ৩৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে একটি পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে এই পাইপলাইন প্রকল্পটি যে কোনোভাবেই ব্যয় সাশ্রয়ী নয় এবং রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে না তা জানিয়ে আমাদের এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তৎকালীন সরকারের কাছে এবং ইতিপূর্বে বর্তমান সরকারের কাছে অনেকগুলো পত্র দিয়েছি। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের মতামত তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু আমাদের এই সকল মতামতকে আমলে না নিয়ে এবং উপেক্ষা করে ও বিপুল অর্থ ব্যয় করে চট্টগ্রাম-ঢাকা জ্বালানি তেল পরিবহনে বিপিসি কর্তৃক নির্মিত পাইপলাইনটি গত ১৬ই আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। পাইপলাইনটি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, বিদ্যুৎ বিল, জমির ভাড়া সহ বিপিসি’র বাৎসরিক ৯০ কোটি টাকা ব্যয় হবে এবং প্রতিবছর প্রকল্প থেকে ৩২৬ কোটি টাকা আয় হবে বলে জানানো হলেও আমরা মনে করি এটি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। সংগঠনটি বলছে, পাইপলাইন নির্মাণের কারণে প্রয়োজনীয় ও কাঙ্ক্ষিত ট্রিপ না পেয়ে ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে জাহাজ মালিকদের পক্ষে জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না এবং এতে করে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আনুমানিক ৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে। যা একটি সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করবে। 

সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মানবজমিনকে বলেন, প্রযুক্তিকে  থামানো যাবে না। পাইপলাইনে তেল সরবরাহের কারণে জাহাজগুলো অন্য রুটে চলে যাবে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অনেক কিছুই ঘটে। এক খাতের শ্রমিক অন্য জায়গায় যাবে। পরিবর্তনের সঙ্গে তারা খাপ খাইয়ে নিবে।