
ভোরবেলায় মাছ কিনতে ফিশারিঘাটের পথে বের হয়েছিলেন তাঁরা। প্রতিদিনের মতো রুটি-রুজির খোঁজে পিকআপে চড়ে রওনা হয়েছিলেন নয়জন। কিন্তু সেই ভোরটা আর ফেরা হলো না পাঁচজনের। চট্টগ্রামের সিটি গেট এলাকায় কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে পিকআপের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই নিভে গেল পাঁচটি তাজা প্রাণ। বেঁচে ফিরলেও গুরুতর আহত হয়েছেন চারজন।
নিহতরা সবাই সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি গ্রামের তরুণ। তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। কারও একমাত্র ছোট ভাই, কারও বাবাহারা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী, কারও আবার স্কুলপড়ুয়া সন্তানের স্বপ্নের ভরসা। একসঙ্গে পাঁচ তরুণের মৃত্যুতে পুরো গ্রামজুড়ে এখন শুধুই হাহাকার।
সোমবার ভোর পৌনে পাঁচটার দিকে নগরের সিটি গেট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এক বাড়ির শোক মিশেছে অন্য বাড়ির শোকে
আকাশ দাশ (১৮) ছিলেন পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই। বৃদ্ধ বাবা বালি দাশ ও মা প্রতীমা দাশ অসুস্থতার কারণে ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে আসতে পারেননি। ভরসার স্তম্ভ ভেঙে যাওয়ার আঘাতে তাঁদের পরিবার এখন স্তব্ধ। আকাশকে মরদেহ নিতে এসে চাচাতো ভাই ধ্রুব দাশ ভেঙে পড়া কণ্ঠে বললেন, “আকাশের রোজগারেই সংসার চলতো। ওর বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ, বাড়ির বাইরে কাজ করতে পারেন না। পাঁচ বোনের ভরসা ছিল এক ভাই। সেই ভাইটাকে আজ আমরা লাশ হয়ে নিতে আসলাম। এখন ওদের কী হবে?”
তিনি আরও বলেন, “আকাশ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটে পরিবারের জন্য যা আয় করতো, তাই দিয়েই সবার সংসার চলতো। মা-বাবার ওষুধ কেনা, বোনদের পড়াশোনা, সংসারের সব দায়িত্ব ওর কাঁধেই ছিল। ওর বোনেরা বারবার বলছে—‘আমাদের ভাইটা ছাড়া আমরা আর কার কাছে যাবো?’ আমি কী উত্তর দেব তাদের?”
ধ্রুব দাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলেন, “আকাশের বয়সই বা কত—মাত্র আঠারো। জীবনের শুরুতেই সব শেষ হয়ে গেল। আমার মনে হয়, পুরো পরিবারটাই এখন পথে বসে গেল। এই দুর্ঘটনা শুধু একটি প্রাণ নেয়নি, একটি পুরো পরিবারকে নিঃস্ব করে দিল।”
অজিত দাশ (৩৫) ছিলেন তিন সন্তানের বাবা। বড় মেয়ে প্রেমা দাশ (১৩) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, মেজো ছেলে প্রমিত দাশ (৯) পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, আর ছোট শিশু কন্যা প্রেমশ্রীর বয়স মাত্র তিন বছর। প্রমিতকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বাবার। স্ত্রী টকি দাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকে কাতর হয়ে বারবার বলছিলেন, “ওগো, এত তাড়াতাড়ি কেন গেলে? আমাকে আর তিনটা ছোট বাচ্চাকে ফেলে তুমি কীভাবে চলে গেলে? আমাদের ছেলে-মেয়েদের কত কষ্ট করে পড়াচ্ছিলে। বলেছিলে, এদের একদিন ডাক্তার বানাবা। এখন কে দেখবে তাদের? সব শেষ হয়ে গেল।”
তিনি হাত তুলে চিৎকার করে বলছিলেন, “তুমি তো শুধু আমার স্বামী না, আমার তিনটা সন্তানের বাবা, তাদের ভরসা। এই বয়সে ওরা বাবাহারা হলো। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ তুমি ছিলে। আজ থেকে সংসারটা কীভাবে চলবে? আমি কোথায় দাঁড়াবো, কী করবো?”
টকি দাশ কান্নার ফাঁকে আরও বলেন, “সকালবেলায় তুমি বের হওয়ার সময় বলেছিলে, দুপুরে এসে সবাইকে নিয়ে খাবে। এখন দুপুর হয়েছে, কিন্তু খাবার তো আর হবে না—তুমি ফিরছ শুধু লাশ হয়ে। আমার সন্তানরা কাঁদছে, বলছে বাবা কোথায়। আমি তাদের কীভাবে সান্ত্বনা দেব?”
রনি দাশ (২৩) ও জুয়েল দাশের (১৮) বাড়িও একই এলাকায়। মো. সোহাগের (৩২) বাড়িও ভাটিয়ারিতে। সবার বাড়িতেই এখন শোকের মাতম।
ঘুমন্ত চালকের ধাক্কা
স্থানীয়রা জানান, সোমবার ভোরে মাছ কিনতে যাওয়ার পথে সিটি গেট এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি কাভার্ডভ্যানকে পিকআপটি পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা মারে। চালকসহ দুজন সামনে বসেছিলেন, বাকিরা গাড়ির পেছনের খোলা অংশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন, যিনি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন, বলেন, “জোরে ধাক্কার শব্দে ছুটে যাই। দেখি পিকআপ ভ্যানটি কাভার্ডভ্যানের পেছনে চেপে গেছে। কয়েকজন ছিটকে পড়ে আছে। মনে হলো চালক ঘুমাচ্ছিলেন।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. আলাউদ্দিন জানান, নয়জন মাছ ব্যবসায়ী পিকআপে ছিলেন। পাঁচজন মারা গেছেন এবং বাকি চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালের সামনে কান্নার স্রোত
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সকাল থেকে নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভরে ওঠে। কেউ বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, কেউ মরদেহের মুখে হাত বুলিয়ে বিলাপ করছেন। নিহত জুয়েল দাশের আত্মীয় পলাশ দাশ কণ্ঠ রুদ্ধ করে বলেন, “ভাই প্রতিদিন মাছ নিয়ে আসতেন। আজ ভোরে বের হলেন, ফিরলেন লাশ হয়ে।”
রনি দাশ ও মো. সোহাগের স্বজনরাও হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন। সোহাগের মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। অসহায়ভাবে বলছিলেন, “ভোরে বলল দুপুরে ফিরবে। এখন আমি কার মুখ চেয়ে বাঁচব?”
একই গ্রামের পাঁচ তরুণের প্রাণহানিতে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারি গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে গভীর শোক। ঘরে ঘরে চলছে কান্নার রোল। যে পথ ধরে প্রতিদিন মাছভর্তি পিকআপ ফিরত, আজ সেই পথেই ফিরল শুধু শোকার্ত স্বজনদের গাড়ি।