
পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে চট্টগ্রাম মহানগরীর রাস্তায় ভয়ঙ্কর ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট কমে আসায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর হঠাৎ পিঁপড়ার সারির মতো নগরীর প্রধান প্রধান সড়কে উঠে আসে এসব অবৈধ রিকশা। রিকশার দৌরাত্মে ট্রাফিক ব্যবস্থা রীতিমত ভেঙ্গে পড়ে। নিত্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি পথ চলতে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হয় নগরবাসী। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের।
এই দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের সহযোগিতায় মাঠে নামেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নগরজুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ-উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করে ট্রাফিক পুলিশ। রিকশা চালকদের বিক্ষোভ আর বাধা উপেক্ষা করে চলমান অভিযানে হাজার হাজার রিকশা জব্দ করা হয়েছে। নগরীর প্রধান প্রধান সড়কসহ বেশির ভাগ সড়ক এখন প্রায় ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত হয়ে গেছে। তাতে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যস্ততম সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। জনমনে ফিরে এসেছে স্বস্তি।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীতে প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষের বসবাস। নগরীর জনসংখ্যার তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা অপ্রতুল। আর এই সুযোগে বিগত ফ্যাসিবাদি সরকারের নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় নগরীতে অবৈধ রিকশা, টমটমের দাপট বেড়ে যায়। নগরীর সড়ক, অলিগলি সয়লাব হয়ে যায় এসব অবৈধ রিকশায়। সরকারি দলের নেতাকর্মী ও ক্যাডারেরা নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে এসব রিকশা নগরীতে চলাচলের সুযোগ করে দিতো।
অবৈধ এসব যানচালকের বিরাট অংশ শিশু-কিশোর। দ্রæতগতি এসব যানবাহন রাস্তায় চলতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় পড়ছে। ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা রাস্তায় আতঙ্ক হিসাবে পরিচিতি পায়। এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া হয়। ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর তৎকালীন সরকারের স্থানীয় নেতাদের সিন্ডিকেটের কারণে এসব অবৈধ রিকশা দাপটের সাথে নগরীতে চলতে থাকে।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর পুলিশ মাঠ ছেড়ে গেলে বেপরোয়া হয়ে উঠে অবৈধ রিকশা চালকেরা। অলিগলি ছেড়ে প্রধান প্রধান সড়কে উঠ আসে এসব ভয়ঙ্কর যান। তাতে রাস্তায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দ্রæতগতির এসব রিকশার বেপরোয়া গতি ছোটখাট দুর্ঘটনায় ঘটাতে থাকে। তাতে রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে বেপরোয়া দাপট। এসব রিকশার সাথে যোগ হয় গ্রামে চলাচলরত সিএনজিচালিত অটোরিকশা (গ্রাম সিএনজি)। অবৈধ ইজিবাইক, টমটম এবং সেই সাথে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাস, মিনিবাস, টেম্পু, হিউম্যানহলারসহ নানা রকমের যানবাহন রাস্তায় চলতে শুরু করে।
নগরীর বৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। আর অবৈধ রিকশার সংখ্যা প্রায় তার দ্বিগুণ। আর ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কতো তা অজানা। ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে এই সংখ্যা কমপক্ষে সত্তর হাজার। এসব অবৈধ এবং ছোট যানবাহনের জোয়ারে ভেঙ্গে পড়ে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা। নগরীর বেশিরভাগ সড়কে যানজট স্থায়ী হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ঘোষণা দিয়ে অবৈধ যানবাহন বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দে মাঠে নামে ট্রাফিক বিভাগ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে শুরু হয় অভিযান। নগরীর চারটি ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে হাজার হাজার রিকশা জব্দ করে। অভিযান শুরু হতেই আওয়ামী লীগের পলাতক শ্রমিক নেতাদের ইন্ধনে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করে চালকদের একটি অংশ। তবে তাতে অভিযান আরো জোরদার হয়।
গত ১৮ এপ্রিল নগরীর চকবাজার কাপাসগোলায় ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা এক শিশুসহ তিনযাত্রী নিয়ে হিজড়া খালে পড়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় ছয় মাস বয়সী একশিশুর মৃত্যু হয়। এর পরদিন থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান আরো জোরদার করা হয়। কোনো ধরনের ব্রেকিং সিস্টেম ছাড়াই অদক্ষ চালকেরা এসব যান নিয়ে রাস্তায় নামছে। এমনকি শিশুদেরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে দেখা যাচ্ছে, ফলে দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ কমিশনার নগরীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেন। এ অবস্থায় এপ্রিলে নগরীতে অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ করার পয়েন্টগুলোতে এবং সড়কে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশা উচ্ছেদে ব্যাপক অভিযান চালানো হয়। এ সময় বিভিন্ন গ্যারেজে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়েও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। জব্দ করা হয় কয়েক হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ব্যাটারি। এসব অভিযানের বিরুদ্ধে মাঠে নামার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন চালকেরা।
সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট নগরীর খুলশি থানা এলাকায় অভিযানের সময় রিকশা চালকেরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। এক পর্যায়ে তারা পুলিশ বক্সে হামলা করে ভাঙচুর। এই ঘটনার জের ধরে পরদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে খুলশী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আফতাব হোসেনকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে মূলত পুলিশ কমিশনার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থানের বার্তা দেন। গত ১১ আগস্ট সিএমপি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নগরবাসীকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করে। তাতে ব্যাপক সাড়াও মিলে। সাধারণ মানুষ এসব রিকশা এড়িয়ে চলে। রাজধানী ঢাকায় যেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে চট্টগ্রামের রাস্তায় অবৈধ যানমুক্ত করতে পারায় নগরবাসী খুশি।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, নগরবাসীর স্বস্তি নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব। ট্রাফিক পুলিশ এবং বিআরটিএর পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছে নগরীতে যানজটের প্রধান কারণ ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন। তাদের অভিযানে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগীতা দিয়ে যাচ্ছি। নগরীতে চলাচলরত লাইসেন্সবিহীন প্যাডেল রিকশার বিরুদ্ধেও অভিযানের কথা জানান মেয়র।
পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে আর নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকবে। নগরীতে কোন অবৈধ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলবে না। গ্রাম সিএনজিও শহরে আসতে পারবে না। লাইসেন্স ছাড়া কোন চালক গাড়ি চালাতে পারবে না। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন আতঙ্কের উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব যান রাস্তায় চলতে পারে না।
এদিকে অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে নগরীতে অভিযান চলছে। ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার নিষ্কৃতি চাকমা বলেন, চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত এক হাজার ১৯৭টি ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করা হয়েছে। ট্রাফিকের অন্য তিনটি বিভাগেও অভিযান চলছে। প্রতিদিন শত শত রিকশা আটক করা হচ্ছে। মামলা দিয়ে জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি এসব রিকশা ডাম্পিং করা হচ্ছে। নগরীর মনসুরাবাদ পুলিশ লাইনসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার রিকশা ডাম্পিং করা হয়েছে। একুশ দিন আটক রাখার পর জরিমানা দিয়ে রিকশা চালকেরা ফেরত নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব রিকশা যাতে আবার রাস্তায় নামতে না পারে সে দিকে নজর রাখছে পুলিশ।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অবৈধ যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে ব্যাটারিচালিত রিকশা যারা তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করতে হবে। মূলত যন্ত্রাংশ হিসাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিভিন্ন অংশ আমদানি করা হয়। পরে এসব যন্ত্রাংশ দিয়ে রিকশা বানিয়ে তা বিক্রি করা হয়। তাই যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রিকশা তৈরি অব্যাহত রেখে অভিযান চালিয়ে রিকশা বন্ধ করা যাবে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যারা আমদানি করে বা সংযোজন করছে বা যেখানে এইসব চার্জিং-এ যাচ্ছে সেখানে কঠোর না হলে সড়কে তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।