
নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের বাসিন্দা আবুল হাশেম (৭৫)। প্রথমে শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। তার ছেলে গণমাধ্যমকর্মী সাইফুল জুয়েল বলেন, টিবি হাসপাতালে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) রেফার্ড করা হয়। চিকিৎসক বলেন ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাবাকে আইসিইউতে নিতে হবে। ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখি আইসিইউর জন্য দীর্ঘ সিরিয়াল। আবেদন জমা দিয়ে বাবাকে বাঁচাতে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করি। ২৫ দিন পর ঢামেক হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা হলেও বাবাকে আর নিয়ে যেতে পারিনি। ওইদিন বাবা মারা যান।
এ চিত্র শুধু সাইফুল জুয়েলের নয়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর প্রতিদিন শত শত স্বজনের এমন আহাজারি চোখে পড়ে। মুমূর্ষু রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় স্বজনদের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে একটি শয্যার জন্য প্রায় ৭০ জন মুমূর্ষু রোগী প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকেন। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ অন্য সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সবসময় রোগীতে ভর্তি থাকে। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় রোগীর স্বজনরা চেষ্টা করেন সরকারি হাসপাতালে একটা আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে। এই টানাপোড়নের মধ্যে অচল হয়ে পড়ে আছে দেশের ১২টি হাসপাতালের আইসিইউ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শ্বাসকষ্টের রোগী বেড়ে যাওয়ায় কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের অধীনে ৪৮ জেলায় সরকারি হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করতে ৫১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে একটি আইসিইউ প্রতিস্থাপনে খরচ হয়েছে গড়ে ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এই সংকটের মধ্যে দেশের প্রায় ১২টি হাসপাতালে আইসিইউ অচল পড়ে আছে। ফলে এখন প্রায় ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। হাসপাতালগুলো হলো; সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া), শেরপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল, বাগেরহাট জেলা সদর হাসপাতাল, মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতাল এবং মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জনবলের অভাবে এসব হাসপাতালের আইসিইউ চালু করা যাচ্ছে না। করোনা মহামারির সময়ে আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এখন অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট সব পর্যায়ের কর্মীর সংকট আছে। চিকিৎসক নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত এ সংকট কাটিয়ে ওঠার।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ হাসপাতালে ১৪০টি আইসিইউ শয্যা এবং ৪০টি এইচডিইউ রয়েছে। এ সংখ্যার দ্বিগুণ আইসিইউ থাকলে রোগী এলে ফেরাতে হতো না। প্রতিদিন প্রায় ৬০-৭০টি আবেদন আসে আইসিইউ শয্যার জন্য। আমাদের এ হাসপাতালে প্রতিদিন ৪ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। এ রোগীদের অনেকের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে অনেক রোগীকে এখানে রেফার্ড করা হয়। এমনকি ঢাকার অনেক টারশিয়ারি হাসপাতাল ও আমাদের এখানে রোগী রেফার্ড করে। এরপর ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর জন্য অনুরোধ আসে। এর মধ্যে হয়তো প্রতিদিন ৩-৪ জন রোগীকে আইসিইউ রোগীর ব্যবস্থা করা যায়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেস্থেসিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন আইসিইউ এর একটি শয্যার জন্য প্রায় ৬৫-৭০ জন রোগীর অনুরোধ আসে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ জনের আবেদনপত্র জমা পড়ে। বাকি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অনলাইনসহ বিভিন্নভাবে আইসিইউতে একটি শয্যার ২৫-৩০টি অনুরোধ আসে। এ হাসপাতালের কেবিন ব্লকে ২১টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে, এইচডিইউ রয়েছে ১০টি। এ ছাড়া সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালে ২০টি আইসিইউ রয়েছে। এর মধ্যে চারটিতে ডায়ালাইসিসের সুবিধা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশের ৪২টি জেলার ৭৪টি সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে মোট ১ হাজার ৩৭২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। এসব শয্যার মধ্যে ৭৫৮টি অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ ঢাকাভিত্তিক ২২টি সরকারি হাসপাতালে বিদ্যমান।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ সহযোগী অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালে ৩৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৩-৫টা আবেদন আসে আইসিইউ শয্যার জন্য। ফাঁকা হলে কোনো দিন একটা বরাদ্দ দিতে পারি, আবার কখনো দেওয়া যায় না। সারা বছরের চেয়ে ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুমে আইসিইউ শয্যার জন্য চাপ বেশি থাকে। এ হাসপাতালে আসা বেশির ভাগ রোগীরই বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউর খরচ বহনের সামর্থ্য থাকে না। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা কিংবা চিকিৎসার জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না। প্রয়োজনীয় কোনো ওষুধ যদি হাসপাতালের স্টোরে না থাকে তাহলে সেটা রোগীর স্বজনদের কিনতে হয়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. সেহাব উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ হাসপাতালে বর্তমানে ২০টি আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। এইচডিইউ দ্রুত চালুর চেষ্টা করেছি। আমি গত সপ্তাহে এ হাসপাতালে যোগদান করেছি। প্রতিদিন প্রায় ৪-৫টি আবেদন আসে আইসিইউ শয্যার জন্য।