
দাতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি, বিদেশি সহায়তা ছাড় ও নতুন প্রতিশ্রুতির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে আসলেও দাতা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি)। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার পালানোর পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরতে দাতাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (বিডিএফ) আয়োজন করতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসলেও ২০২০ সালের পর এই ফোরামের সভা আয়োজন করেনি ইআরডি। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগের দায়িত্বশীলরা যেন জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন।
মূলত হাসিনার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী। আর এ জন্য দেশ এবং দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়াই যেন তার লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হওয়ায় পুরষ্কার হিসেবে শাহরিয়ার কাদের ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০১৬ সাল পর্যন্ত ২ বছর ৯ মাস ২৯ দিন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকের একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই শেষ নয়, সর্বশেষ ২৩ নভেম্বর ২০২৩ সালে ইআরডি’র সচিব করা হয় তাকে। এখনও সে পদে বহাল তবিয়তে আছেন আওয়ামী স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা। এমনকি এই পদে থেকে দেশের অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলতে দাতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না, বিদেশি সহায়তা ছাড় ও নতুন প্রতিশ্রুতির পরিমাণ দিন দিন কমলেও বাস্তব কোন পদক্ষেপ বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
গত অর্থবছর (২০২৪-২৫) অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে মাত্র ৮৩২ কোটি ৩৩ লাখ মার্কিন ডলার বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি সংগ্রহ করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। যার বেশিরভাগই পূর্বের জের। এর আগের অর্থবছরে সংগ্রহ করা ১ হাজার ৭৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের তুলনায় এক বছরে প্রতিশ্রুতি কমেছে ২৪১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার বা ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে কয়েক বছরে বড় ধরনের ঋণদাতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে কোন সহায়তার প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি গত এক দশকে সর্বনি¤œ অবস্থানে চলে এসেছে।
ইরডির ‘ফ্লূ অব এক্সটারর্নাল রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭০৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার থেকে এর পরের বছর বেড়ে দাড়ায় ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ১৮ লাখ ডলারে। এ হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে গত অর্থবছর। দাতাদের সঙ্গে নতুন ঋণ ও অনুদান চুক্তি কমে আসায় বিদেশি সহায়তার ছাড়ও আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে বলে ইআরডির সূত্রে জানা গেছে।
গত অর্থবছরে সব মিলে মাত্র ৮১১ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি সংস্থাগুলো। এর আগের বছল বিদেশি ঋণ বাবদ দেশে মোট ৯৪৮ কোটি ২ লাখ ডলার দেশে এসেছিল। এ হিসাবে এক বছরে বিদেশি ঋণের ছাড় কমেছে ১৩৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, বা ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এক দিকে প্রতিশ্রুতি ও সহায়তা কমে আসলেও ঋণের হার বৃদ্ধির কারণে সুদ ও আসল বাবদ বিদেশি ঋণের দায় দেনা বেড়েই চলেছে। গত অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে সরকার ৪০৮ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার ব্যয় করেছে। এর আগের বছরে বিদেশি ঋণের দায় দেনা পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ৩৩৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এক বছরেই ঋণ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৭১ কোটি ৫৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা বা প্রায় ২১ দশমিক ২২ শতাংশ।
দেশীয় মূদ্রায় বিদেশি ঋণ পরিশোধে এক বছরে ব্যয়ভার ৩৭ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায়। এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ব্যয়ে ১১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা বৃদ্ধির নজীর অতীতে নেই বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঋণের আসল পরিমোধে এক বছরে ব্যয় বেড়েছে ৮ হাজার ৯১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বা ৪০ শতাংশ। একই সময়ে সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ২০ দশমিক ৩২ শতাংশের বেশি। ঋণ সহায়তা কমে আসার বিপরীতে পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ঋণের বড় একটো অংশই দেশের উন্নয়নে কাজে না লেগে উল্টো পরিশোধেই চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ইআরডির তথ্য বলছে, গত বছরে দাতারা যে পরিমাণ অর্থ ছাড় করেছে তার ৫০ দশমিক ৩৭ শতাংশই চলে গেছে অতীতের দায় দেনা পরিশোধে। আর এক বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
কয়েক বছর ধরে ছাড় হওয়া বিদেশি সহায়তার মাত্র ১৯ থেকে ২৮ শতাংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করে আসছে সরকার। দাতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি, বিদেশি সহায়তা ছাড় ও নতুন প্রতিশ্রুতির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে আসলেও দাতা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইআরডি। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়েও কোন পদক্ষেপ নেই ইআরডি’র। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত পাল্টা শুল্কের দেন-দরবারেও দেখা যায়নি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কোন উদ্যোগ।
বাংলাদেশে সৈরশাসকের পতনের পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরতে দাতাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (বিডিএফ) আয়োজন করতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে আসলেও ২০২০ সালের পর এই ফোরামের সভা আয়োজন করেনি ইআরডি। দাতা সংস্থাগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে লোকাল কনসালটেটিভ গ্রুপের (এলসিজি) সভার আয়োজনেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না ইআরডির সচিব। এছাড়া এক চীন ছাড়া কোন দেশের সঙ্গেই জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন (জেইসি) সভারও আয়োজন করা হয়নি।
নেগোসিয়েশনে দুর্বলতায় বাড়ছে সুদের হার
জাপান বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক সাহায্যদাতা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে জাপান বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে আসছে। অথচ প্রথমবারের মতো জাপানি ঋণের জন্য ২ শতাংশ হারে সুদ দেবে বাংলাদেশ। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে এই হার প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের জন্য জাপানের ঋণে এটাই সর্বোচ্চ সুদহার, যা এর আগে কখনো ছিল না। ইতোমধ্যেই সই হওয়া চুক্তির আওতায়, এ প্রকল্পের জন্য জাপান থেকে ৬৩ কোটি ডলার (৬৩০ মিলিয়ন) অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে। এর আগে, বাংলাদেশের জন্য জাপানি ঋণ বরাবরই স্বল্পসুদে পাওয়া যেত এবং তা অত্যন্ত কাঙ্খিত-ও ছিল। তবে ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপানি ঋণের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। শুধু নির্মাণ প্রকল্প নয়, একই প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে নেওয়া ঋণের সুদহারও বেড়ে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জাপানি ঋণের সুদহার বৃদ্ধির একটি স্পষ্ট ধারা তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) শুরুতে, অর্থাৎ গত নভেম্বর মাসে নেওয়া প্রথম জাপানি ঋণের সুদহার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর তা পর্যায়ক্রমে বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮৫, ১ দশমিক ৯৫ এবং সর্বশেষ চুক্তিতে ২ শতাংশে পৌঁছেছে।
ফলে জাপানি ঋণের সুদহার এখন অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে চলে এসেছে। অথচ ২০২২ সাল পর্যন্ত জাপানি ঋণের সুদহার ছিল ১ শতাংশের নিচে। এর আগে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা বাংলাদেশের জন্য ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে। এমনকি ১০০ টাকায় এক বছরে মাত্র ১ পয়সা হারে সুদ নেওয়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও প্রথমবারের মত এক শতাংশ হারের সুদে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এর ফলে দেশটির ঋণের সুদের হার বাড়ছে ১০০ গুন। কালুরঘাটে রেল সেতু নির্মাণে নতুন এই সুদে ঋণ চুড়ান্ত করছে ইআডি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোরিয়া থেকে মোট ৮১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার ঋণ আসবে। এর মধ্যে ৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার আসবে ইকোনমিক ডেভলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে। আর ৯ কোটি ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার আসবে এন্টারপ্রাইস ডেভলপমেন্ট প্রোপার্টি ফান্ড (ইডিপিএফ) থেকে। কোরিয়ার ইডিসিএফ ঋণের সুদের হার শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ। আবার এই ঋণ পরিশোধে সময়ও পাওয়া যায় ১৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছর। অন্যদিকে ইডিপিএফ ঋণে এক শতাংশ বর্ষিক সুদের ঋণ পরিশোধে সময় পাওয়া যায় ৩০ বছর, যেখানে গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর।
এদিকে ভবিষ্যতে ঋণের চাপ আরও বাড়বে। কারণ, বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ শুরু হচ্ছে। যেমন- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি। জাপানকে এ অর্থ দিতে হবে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ও মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শুরু হয়েছে। ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, বড় বড় মেগা প্রকল্পের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।
দাতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি, বিদেশি সহায়তা ছাড় ও নতুন প্রতিশ্রুতির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে আসার বিষয়ে ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইলে কথা বলিনা। পিএস এর সঙ্গে কথা বলে সময় নিয়ে আসতে বলেন।