
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৬ হাজার ৩৯৯। ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ২৪১।
২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রিন্ট মেকিং বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী, প্রার্থীর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪ দশমিক ২৫ ও প্রিন্ট মেকিং বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে অন্তত ৩ দশমিক ৫০ বা প্রথম শ্রেণী থাকতে হবে। তবে এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল বশির, ঝোটন চন্দ্র রায় ও স্বপন কুমার সানা নিয়োগ পেয়েছিলেন এসব শর্ত পূরণ না করেই। দেশের সবচেয়ে পুরনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দেড় দশকে নিয়োগ পেয়েছেন ১ হাজার ৪০০-এরও বেশি শিক্ষক। তবে অভিযোগ আছে, এসব শিক্ষকের বড় অংশই নিয়োগ পেয়েছেন দলীয় বিবেচনায় শর্ত শিথিল, আর্থিক লেনদেনসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, একই ধরনের অভিযোগ ছিল অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ১৬ হাজার ৩৯৯। ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ২৪১। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী গত দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ৮০০ জন। সে হিসেবে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কর্মরত শিক্ষকদের ৫৪ শতাংশই নিয়োগ পেয়েছেন গত ১৫ বছরে। এদের বড় অংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় স্বজনপ্রীতি, দলীয় বিবেচনা, শর্ত শিথিল, আর্থিক লেনদেনসহ অবৈধ উপায়ে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি জুলাই ছাত্র অভ্যুত্থানের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি আমলাসহ বিভিন্ন সরকারি খাতে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এসব কমিটি এখনো তাদের প্রতিবেদনই জমা দেয়নি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত দেড় দশকে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করে এবং নিয়োগ পরীক্ষায় ভালো করেও দলীয় পরিচয় না থাকায় বা তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সুপারিশ না থাকায় নিয়োগ পাননি। অন্যদিকে দলীয় কর্মী, ঘনিষ্ঠ ও সমর্থকদের শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি কখনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না, পড়ালেখাতেই ব্যস্ত থাকতাম। ফলাফলও ভালো ছিল। স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা করব। দেশের মোট চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনোটিতেই সিলেক্টেড হইনি। দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হওয়ার পর বড় ভাইয়েরা পরামর্শ দিয়েছিল রাজনৈতিক সুপারিশ নিয়ে ভাইভায় অংশগ্রহণ করার। এরপর একটি ভাইভায় আমাকে স্নেহ করতেন এমন এক বড় ভাই তৎকালীন উচ্চপর্যায়ের এক নেতার সুপারিশের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। তাতেও লাভ হয়নি। পরে জানতে পেরেছিলাম, ওই নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশকৃত প্রার্থী ছিলেন। আমাকে তখন সিলেকশন বোর্ডের এক শিক্ষক বলেছিলেন, তারা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থা করে দেবেন। আসলে ঘুরেফিরে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন বোর্ডে কিছু নির্দিষ্ট শিক্ষকরাই থাকতেন। এ সিন্ডিকেটই মূলত সব নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করত।’
ঢাবির সাবেক এ শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ভালো। সৎভাবেই তারা খুব ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। এর পরও তারা কেন এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন বুঝতে পারি না। তাদের কারণে এমন অনেকে শিক্ষক হচ্ছেন যারা পড়াতে পারেন না। এ কারণে দেশের উচ্চশিক্ষার মান ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।’
গত দেড় দশকে বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধেও। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০২৩ সালে ইতিহাস বিভাগে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ৩৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী শামসুদ্দোহা মনি, ৪০ ব্যাচের শিক্ষার্থী সারাফত আদনান বিপ্লব ও ৪২ ব্যাচের শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা। অভিযোগ ওঠে, ওই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফলধারী ছাত্রী ৪৩ ব্যাচের মারিয়া আক্তারকে বাদ দেয়া হয়েছিল। মারিয়া আক্তার এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫, স্নাতক পরীক্ষায় সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭৬ ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ৩ দশমিক ৭৭ পেয়েছিলেন।
ওই সময়ে বিভাগটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম দাবি করেছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুসারে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এ ঘটনার কিছুদিন পর লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছিলেন বিভাগটির ৪২তম ব্যাচের জান্নাত আরা নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি চিঠিতে দাবি করেন, সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য ও নৈতিক অবক্ষয়সম্পন্ন প্রার্থীর নাম নিয়োগ বোর্ড থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে ওই সময়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নীরব ভূমিকায় রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা জুলাই হামলায় জড়িতদের বিচার করা ও অন্যান্য বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া এ মুহূর্তে জাকসু নির্বাচন নিয়েও কাজ চলছে। সব মিলিয়ে আমরা এতদিন পারিনি। অনেকের দাবি এটা। আশা করি আগামী দিনে এটা নিয়ে কাজ করা যাবে।’
বিগত সরকারের সময় নিয়োগ বাণিজ্যের জেরে যেসব উপাচার্য সমালোচিত ছিলেন তাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। চার বছরে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ আছে, এদের প্রায় সবাইকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল দলীয় বিবেচনায়। ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়োগ সম্পর্কিত বেশকিছু অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। সেসব রেকর্ডে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে ৮ লাখ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর জন্য ১০-১২ লাখ, কর্মকর্তার জন্য ১৫-১৬ লাখ, আর শিক্ষকের ক্ষেত্রে ১৬ লাখ টাকা দাবি করতে শোনা যায়। তবে এসব বিষয়ে তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ১৬ বছরের নিয়োগ ও আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও এখনো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি যে শুধু বিগত ১৫ বছর হয়েছে এমন নয়। এটি আরো আগে থেকেই চলছে, বিগত ১৫ বছরে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। এ ধরনের দুর্নীতির পেছনে প্রধান কারণ দলীয়করণ। রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে গিয়ে দলীয় প্রার্থীদের যেকোনো উপায়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। এতে মেধাবীরা উপেক্ষিত থেকেছে। এর জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন যৌক্তিক। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ স্বায়ত্তশাসনকে কাজে লাগিয়ে জবাবদিহির জায়গাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট গঠনের প্রক্রিয়াটা এমন করা হয়েছে যে সেখানে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ আছে। নিয়োগ দুর্নীতি বন্ধে এসব আইন সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইতোপূর্বে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছে তাদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্নীতির প্রবণতা কমবে।’
দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রেও। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৩৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত অধ্যাপক আবদুস সোবহানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।
নিয়োগে অনিয়ম প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত দেড় দশকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শর্ত ও ফলাফল শিথিল করা, অর্থের বিনিয়োগ, দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করেছে। এজন্য উন্মুক্ত অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; এছাড়া ই-মেইল ও বেনামি বিভিন্ন উপায়ে অভিযোগ চিহ্নিত করা হচ্ছে। যদিও অভিযোগের সংখ্যা খুব বেশি নয়, আমরা আরো তথ্য আশা করেছিলাম। তবে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যে আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাদিকুল সাগর, চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক সুজন সেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদসহ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারো ক্ষেত্রে সাময়িক বহিষ্কার, আবার কারো ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের বহিষ্কারাদেশ দেয়া হয়েছে।’
শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মতে, নিয়োগে অনিয়মের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। বিশেষত আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে এ ধরনের অভিযোগ বেশি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে দলীয়করণের পাশাপাশি উপাচার্যদের স্বজনপ্রীতিও প্রাধান্য পেয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতির জেরে এক দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ২০২২ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শর্ত পূরণ না করেও নিয়োগ পান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে অহনা আরেফিন। এর কিছুদিন পরই ২০২৩ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে নিয়োগ পান গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের মেয়ে ফারজানা মাহবুব। অভিযোগ ছিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের মেয়ের নিয়োগ নিশ্চিত করতে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে অহনা আরেফিনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন একিউএম মাহবুব। ঘটনাটি তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলেও উভয় উপাচার্যই আওয়ামীপন্থী হওয়ায় ইউজিসি বা সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে রদবদল এলেও বিগত দেড় দশকের অবৈধ নিয়োগ বা দুর্নীতির বিষয়ে এ দুই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
নিয়োগ দুর্নীতির জেরে আলোচিত হন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খান। তিনি ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৪২৬ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল এদের অধিকাংশই নিয়োগ পেয়েছিলেন আত্মীয়তা কিংবা দলীয় পরিচয় সূত্রে। ইউজিসি ওই সময়ে এসব অনিয়মের সত্যতা পাওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরিচ্যুত করার সুপারিশও করেছিল। তবে এখনো সে সুপারিশ কার্যকর হয়নি। এমনকি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতি অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে।
টিআইবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রকাশনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, বিজ্ঞপ্তির বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ, পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। এমনকি আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদে নিয়োগে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের তথ্যও উঠে আসে। এছাড়া গত দেড় দশকে প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস, আর্থিক লেনদেন ও ঘুস গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্যমতে, গত দেড় দশকের পুরো সময়জুড়ে চিত্রটি কমবেশি একই রকম ছিল। তবে শেষের বছরগুলোয় তা আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষকরাই বাধা প্রদান করছেন বলে উল্লেখ করেছেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক উপাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দলীয় মতবাদের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে সবাই একমত। এমনকি এ নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে একাধিকার বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে। যদি মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেয় তাহলেই ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। অন্যথায় ব্যবস্থা নিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়বে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘যদি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসে তাহলে সাধারণত আমরা এ বিষয়গুলো কমিটির মাধ্যমে করি। এ পর্যন্ত আমাদের দুই ধরনের কমিটি করা হয়েছে। একটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, আরেকটি শিক্ষকদের জন্য। যদি কেউ মনে করে তার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বা সুবিচার পাননি, আবেদন করলে প্রত্যেক ঘটনা বা পরিস্থিতি স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করার জন্য তিনজন ডিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দেবেন। নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগ আসে, তা হলো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এস এম এ ফায়েজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের একটি বিষয় রয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের কাছে যদি এ ধরনের সুস্পষ্ট অভিযোগ, তথ্য-উপাত্ত আসে তবে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেব।’