Image description

মৃত মায়ের সই জালিয়াতি করে টাকা আত্মসাৎসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আহমেদ ইফতেখারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে থাকা প্রায় ৪০ কোটি টাকার এফডিআরেরও কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। ইউএসটিসির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় থাকার সুযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণগ্রস্ত করে রেখেছেন তিনি। এছাড়া জনসেবার জন্য দাতাদের সহযোগিতায় তার বাবার কেনা জমি নিজের নামে করে নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মৃত মাকে জীবিত দেখিয়ে ও সই জাল করে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে দুই কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করেন ইফতেখার। এর প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিএসইসির ২০২১ সালের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান ইউএসটিসির প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা ইসলাম। তার মৃত্যুর প্রায় আড়াই বছর পর ২০১৫ সালের ১৪ মে তার ছেলে ইফতেখার একই শেয়ার দুটি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান আহমেদ ইকবাল হাসান সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও রয়েল ক্যাপিটাল লিমিটেডের মাধ্যমে স্থানান্তরের আবেদন করেন। আবেদনপত্রে আনোয়ারা ইসলামের সইয়ের সঙ্গে সত্যিকারের সই মেলেনি। স্থানান্তরিত শেয়ার পরে রয়েল ক্যাপিটাল লিমিটেডের মাধ্যমে বিক্রি করে মোট ২ কোটি ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ইফতেখারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিএসইসির তদন্ত কর্মকর্তারা দেখেছেন যে, ওই দুটি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই, নিরাপত্তা নিয়ম অমান্য করে এই কার্যক্রমে সহায়তা করেছে। এই ঘটনার ফলে শেয়ারবাজার আইন লঙ্ঘিত হয়েছে।

 

জমি দখল

জনসেবার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউএসটিসির প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম কর্ণফুলীর মইজ্জার টেক এলাকায় ৩ হাজার ৪০০ শতক জমি কেনেন জনসেবা ফার্মা লিমিটেডের নামে। এই জমিটি কেনা হয়েছিল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য। এই উদ্যোগে বিভিন্ন দাতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সহায়তা করেন। লক্ষ্য ছিল—দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

কিন্তু নুরুল ইসলামের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে এই সুযোগে তার ছেলে ইফতেখার ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে জনসেবা ফার্মা লিমিটেডের জমি নিজের নামে করে নেন।

২০০৫ সাল পর্যন্ত নুরুল ইসলামের সহকারী ছিলেন মো. মাহবুব ইসলাম। ওই জমি কেনা প্রসঙ্গে তিনি আমার দেশকে বলেন, কর্ণফুলী এলাকায় যখন নুরুল ইসলাম সাহেব জমিটি কেনেন, তখন তার অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিকল্পনা ছিল দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া।

স্বর্ণপদক পাওয়া প্রার্থীকে দেওয়া হয়নি নিয়োগ

চলতি বছরের গত ১২ জুলাই ইউএসটিসির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে জয়া শীল নামে এক প্রার্থীকে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত করা হয়। ওই প্রার্থী একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বিশেষ কৃতিত্বের কারণে তিনি চ্যান্সেলর স্বর্ণপদকও অর্জন করেন। নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও সদস্যরা লিখিতভাবে অনুমোদন দিলেও রেজিস্ট্রার শেষ মুহূর্তে নিয়োগপত্র ইস্যু করেননি। এই বিষয়ে জয়া শীলের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. আমাম জোনায়েদ সিদ্দিকী। তিনি আমার দেশকে বলেন, আমাদের কাছে জয়া শীল যোগ্য মনে হয়েছে। তাকে সুপারিশও করেছিলাম। কিন্তু পরে শুনি তাকে নেওয়া হয়নি।

ভাইভায় অংশ নেওয়া অপর প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন ফলাফল নিয়েও যদি চাকরি না হয়, তবে নিয়োগ বোর্ডের বৈঠক, সাক্ষাৎকার সবই কি কেবল আনুষ্ঠানিকতা?

পূর্ববর্তী নিয়োগবোর্ডে একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া আরেকজন প্রার্থী বলেন, আমাকে জানানো হয়েছিল যে, বোর্ডে আমি নির্বাচিত। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর জানানো হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত। পরে আর কোনো উত্তরই পাইনি।

বিভাগের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রেজিস্ট্রার দিলিপ বড়ুয়া ও চেয়ারম্যান আহমেদ ইফতেখারের কথায় চলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়। এ ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে, যেখানে বোর্ডের সুপারিশ প্রশাসন উপেক্ষা করেছে। এখানে নিয়োগ অনেক সময় যোগ্যতা বা বোর্ডের সিদ্ধান্তে হয় না, হয় ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা চাপের কারণে। এতে বিভাগ মেধাবী শিক্ষক হারাচ্ছে।

এফডিআরের টাকা আত্মসাৎ

ইউএসটিসির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় একাধিক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন ইফতেখার। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিমভাবে ঋণগ্রস্ত দেখানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম মারা যাওয়ার আগে ইউএসটিসির জন্য ৪০ কোটি ৬০ লাখ টাকা এফডিআর করে যান। কিন্তু এই টাকার কোনো হিসাব নেই। ২০১৪ সালে ট্রেজারারের দায়িত্বে ছিলেন আসহাব উদ্দিন। তিনি আমার দেশকে বলেন, ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ ইফতেখারের কাছে ৪০ কোটি ৬০ লাখ টাকা রেখে আসি।

ইউএসটিসিতে কাজ করা অন্তত ১০ জন শিক্ষক ও ট্রেজারার জানান, ইফতেখার ইউএসটিসির আর্থিক ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানের তহবিল গোপনে স্থানান্তর করেন এবং হিসাবের স্বচ্ছতা রক্ষা না করে নানা ধরনের আর্থিক জটিলতা সৃষ্টি করেন।

এই অর্থ সরানোর প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি খালি চেকে সই দিয়ে ইফতেখারের হাতে তহবিল ব্যবস্থাপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, ড. আবছার এসব অনিয়ম ও লেনদেন সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং জেনেশুনেই সহযোগিতা করেছেন।

খালি চেকে সই না করার কারণে অনেকের চাকরিও গেছে। এমনই একজন হলেন সাবেক ট্রেজারার ও ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফসিউল আলম। তিনি বলেন, প্রায় সময় খালি চেকে সই করতে বলত ইফতেখার। আমি দ্বিমত করায় আমার চাকরিটাই নাই হয়ে যায়।