
২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪। ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘ এ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, অপশাসনের রাজত্ব সৃষ্টি করা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে এখন অবাঞ্ছিত ও নিষিদ্ধ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো ছাত্র-জনতার বুকের রক্ত ঝরানো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার অপরাজনীতির দোসরদের ও আওয়ামী লীগকে দেশের সাধারণ মানুষ সম্মিলিত প্রতিরোধে ছুড়ে ফেলেছে ঘৃণার সাগরে।
দেশের মাটিতে তাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন অপ্রাসঙ্গিকই নয়; বরং জনধিকৃতও বটে। তবে পলাতক শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের আশ্রয় দেওয়া ভারত এই দেশে তাদের হাসিনা আমলের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফেরাতে মরিয়া। এ জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতে আওয়ামী লীগের অফিস খোলার অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তারাও বাংলাদেশবিরোধী নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারা ভারতীয় আশ্রয়ে থেকে সে দেশে পুরোদস্তুর অফিস খুলে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান একদিকে যেমন প্রশ্ন তোলে ভারতের নৈতিক অবস্থান নিয়ে, অন্যদিকে তা বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বকেও ফেলে হুমকির মুখে। কারণ শেখ হাসিনা এবং তার দল যে কৌশলে ভারতের ছায়াতলে থেকে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, সেটি শুধু আশ্রয়ের গল্প নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ ভূরাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ।
সম্প্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার উপনগরীর একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে ‘পার্টি অফিস’ খুলে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। অফিসটির আকার মাত্র ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফুট। কোনো সাইনবোর্ড নেই, শেখ হাসিনা ও তার বাবার কোনো ছবিও নেই। এমনকি দলীয় দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার কোনো ফাইলপত্রও নেই। সবকিছুই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেন দলটির অস্তিত্ব সেখানে দৃশ্যমান না হয়। এ যেন এক ধরনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অপারেশন’, যার মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী নেতারা দলকে সংগঠিত করছেন।
ভারতে আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু ভবিষ্যৎ প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা নয়, বরং এটি ভারতের একটি কৌশলগত দাবার চাল, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে। স্বাধীন দেশের একটি রাজনৈতিক দল যদি অন্য দেশের মাটিতে গিয়ে দলীয় কর্মকাণ্ড চালায়, তবে সেটি কি শুধু আত্মরক্ষার কৌশল, না কি একটি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী আগ্রাসী রাজনীতির অংশ—এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে উঠছে স্বাভাবিকভাবেই। যারা ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেছিলেন, তারাই আজ প্রশ্ন তুলছেন, ভারত কি সত্যিই বাংলাদেশের বন্ধু, না কি এক আধিপত্যবাদী শাসক?
আওয়ামী লীগের কলকাতা অফিস কার্যত একটি ‘রাজনৈতিক নির্বাসন’-এর দৃষ্টান্ত। এটি ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত একটি সরাসরি পক্ষ হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু অংশ এ ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে প্রচার করছে। তাদের যুক্তি, ‘আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতবান্ধব দল আর কলকাতা হচ্ছে বাঙালির রাজধানী। তাই এখানে তাদের পার্টি অফিস থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
কিন্তু এই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের নামান্তর। কোনো স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দল অন্য দেশে সংগঠিতভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে না। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মৌলিক নীতি। ভারত যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়, তবে তাদের উচিত ছিল এ ধরনের অফিস চালানোর অনুমতি না দেওয়া।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা মূলত কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র, জেলাপর্যায়ের নেতা, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারাও। কেউ কেউ সপরিবারে, কেউ বা কয়েকজন মিলে একটি ফ্ল্যাটে বাস করছেন। আনুমানিক ৮০ জন সাবেক সংসদ সদস্যসহ প্রায় ২০০ জন আওয়ামী ঘরানার প্রভাবশালী ব্যক্তি এখন কলকাতায় রয়েছেন। এ সংখ্যা সময়ের সঙ্গে হয়তো আরো বাড়বে।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে জনগণের জাগরণ। এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল ভারতের প্রভাবমুক্ত, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। অথচ সেই প্রেক্ষাপটে যখন দেখা যায় পরাজিত সরকারি দল বিদেশে গিয়ে ‘শরণার্থী রাজনীতি’ করছে, তখন জনগণের আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়, এই দলটি শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নয়, সার্বভৌমত্বকেও বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত।
ভারতের আগ্রাসনের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। দেশের জলসীমায় আগ্রাসন, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া, বাজার দখল, ট্রানজিট, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এসবই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত যেন একটি ‘ডিপ্লোম্যাটিক প্রক্সি’ তৈরি করেছিল। তারা জানত, এই দল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণ ভারতের পক্ষে থাকবে। তাই আওয়ামী লীগের পতনের পর ভারত সরকার উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। আর সেই উৎকণ্ঠা থেকেই এই ‘কলকাতা অফিস’, যা এক অর্থে ভারতীয় ভূরাজনীতির নিরাপত্তা বলয়ের অংশ।
বাংলাদেশের জনগণ আজ সচেতন। তারা ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে জানে, আবার দীর্ঘ ৫০ বছর দেশের অভ্যন্তরে ভারতের হস্তক্ষেপকেও অনুধাবন করতে শিখেছে। আর তাই কলকাতায় আওয়ামী লীগের ‘পার্টি অফিস’ জনগণের কাছে এক ভয়ংকর বার্তা হয়ে এসেছে। বার্তাটি হচ্ছে—বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী দেশ ভারত সক্রিয় থাকতে চায়, যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র নয়, বরং তাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
বছরের পর বছর ধরে ভারত নিজেদের বাংলাদেশের ‘বড় ভাই’ হিসেবে জাহির করে আসছে। অথচ সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা, বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার অস্বীকার এবং রাজনৈতিকভাবে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এই ‘বড় ভাই’-এর মুখোশ খুলে দিয়েছে। কলকাতায় ‘পার্টি অফিস’ খোলা এই আগ্রাসনেরই নতুন রূপ, একটি সফট কূটনৈতিক অভিযান, যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশে তাদের অনুগত রাজনৈতিক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
ভারত সরকারের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের রাজনৈতিক দপ্তর পরিচালনা অসম্ভব। অর্থাৎ ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ও গোয়েন্দা তদারকির মধ্য দিয়েই কলকাতায় বাংলাদেশের একটি বিতাড়িত রাজনৈতিক দল টিকে আছে। এটি ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ, যেখানে বাংলাদেশে তাদের একক অনুগত শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য।
আওয়ামী লীগ ভারতে বসে রাজনৈতিক বৈঠক করছে, ভার্চুয়ালি নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে দল পরিচালিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দিল্লির উপকণ্ঠে থাকলেও মাঝেমধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল ৩১ জুলাই। এসব আয়োজন প্রমাণ করে, দলটির মূল নেতৃত্ব এখন দেশের বাইরে থাকলেও তারা তাদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে একটুও সরে আসেনি।
আওয়ামী লীগের এই অবস্থান দলের অনেক দলটির অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ কর্মীরা দেশে দমন-পীড়নের শিকার হলেও শীর্ষ নেতারা ভারতে নিরাপদে অবস্থান করছেন। এটি সাংগঠনিক নৈতিকতার দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও পঙ্কজ দেবনাথের মতো নেতারা বলছেন, ‘জেলে গেলে বা মারা পড়লে সংগঠন গড়া যেত না।’ এই অবস্থান নিঃসন্দেহে বিতর্কিত। কারণ এটি দেশপ্রেম নয়, বরং ক্ষমতায় ফিরে আসার এক চাতুর্যপূর্ণ প্রয়াস।
বর্তমানে দলটির কর্মকাণ্ড পরিচালনার অর্থনৈতিক ভার বহন করা হচ্ছে তথাকথিত ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’দের সহায়তায়। এই অর্থায়ন কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কলকাতায় আওয়ামী লীগের এই ‘পার্টি অফিস’ শুধু একটি রাজনৈতিক দপ্তর নয়, এটি ভারতের ভূরাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি গুরুতর হুমকি। ভারতের সরকারি অনুমোদনে এই অফিসের মাধ্যমে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ ও পুনর্গঠন চলছে। বাংলাদেশের একটি দলের অন্য দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
লেখক : রাজু আলীম- কবি ও সাংবাদিক