
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। অবকাঠামো গড়ে তোলা, উড়োজাহাজ সংগ্রহ ও এজন্য দরকারি সভরেন গ্যারান্টি, দেশের বিমানবন্দরগুলোর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পাওয়াসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু তার পরও গত ৫৪ বছরে ভালো এয়ারলাইনসের কাতারে যেতে পারেনি বিমান। উল্টো ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি, ফ্লাইট বাতিল, সূচি পরিবর্তন, অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা বিভিন্ন এয়ারলাইনসের চেয়ে বেশি ভাড়া, ফ্লাইটের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের মান নিয়ে প্রশ্নসহ বিভিন্ন কারণে সমালোচনা পিছু ছাড়েনি সংস্থাটির।
যাত্রীসেবার মানে সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বিশ্বের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর র্যাংকিং করে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এয়ার ট্রান্সপোর্ট রেটিং প্রতিষ্ঠান স্কাইট্র্যাক্স। ২০২৫ সালে স্কাইট্র্যাক্সের করা শীর্ষ ১০০ এয়ারলাইনসের তালিকায় বিমান বাংলাদেশের নাম নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় বিমান আছে ৯ নম্বরে। নিরাপত্তা ও গুণগত মানের বিচারে ২০১৬ সালে স্কাইট্র্যাক্সের করা বিশ্বের ২১টি খারাপ এয়ারলাইনসের তালিকায় নাম উঠেছিল বিমানের।
স্কাইট্র্যাক্স বলছে, উড়োজাহাজের আসন, সুযোগ-সুবিধা, খাবার ও পানীয়, ফ্লাইটে বিনোদনের ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন সূচক এবং ফ্লাইট ও ফ্লাইটের বাইরে কর্মীদের সেবার মান অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশ তিন তারকা এয়ারলাইনস হিসেবে সনদপ্রাপ্ত। যদিও এ সূচকগুলোর বেশির ভাগের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিমানের যাত্রীরা।
বর্তমানে বিমানের বহরে ১৯টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯, চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮, চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও পাঁচটি ড্যাশ-৪০০ উড়োজাহাজ। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে ২২টি আন্তর্জাতিক ও সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে সংস্থাটি। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়েছে বিমানের ফ্লাইট। উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড হয়ে যাওয়া, মাঝ আকাশ থেকে ফ্লাইট ফিরিয়ে আনা, ফ্লাইট বাতিল, সূচি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে আলোচনায় রয়েছে সংস্থাটি।
যদিও বর্তমানে কোনো উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড অবস্থায় নেই জানিয়ে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) এবিএম রওশন কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে যে ঘটনাগুলো বিমানে ঘটেছে, সেগুলো প্রতিটিই আলাদা। আমাদের প্রকৌশলীরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছেন। এছাড়া একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন তানভীর খুরশিদ কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। কেন এত অল্প সময়ের মধ্যে এ ঘটনাগুলো ঘটছে, তা কমিটি দেখবে। তারা কারণ বের করবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে কমিটি প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।’
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইএটিএ) হিসাবে, বর্তমানে বাংলাদেশে বার্ষিক উড়োজাহাজ যাত্রীর সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। প্রতি বছর ১০ শতাংশের বেশি যাত্রী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশে বার্ষিক উড়োজাহাজ যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় আড়াই কোটিতে। আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাত্রীসেবার নিম্নমান, ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটি, দুর্ঘটনার শঙ্কা, তুলনামূলক বেশি ভাড়াসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে আকাশপথের ক্রমবর্ধমান যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে বিমান। প্রবাসী কর্মী ছাড়া সাধারণ যাত্রীরা বিমানে ভ্রমণ পারতপক্ষে এড়িয়ে চলছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘৫৪ বছরে একটি এয়ারলাইনস উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়ার কথা। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার যে বিমান এটা করতে পারেনি। বাংলাদেশে কিন্তু যাত্রীর অভাব নেই। বিমানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সেবা না পেয়ে এ যাত্রীরা অন্য বিদেশী এয়ারলাইনসে যাতায়াত করছেন। আসলে বিমানকে কখনই একটি যুগোপযোগী এয়ারলাইনস হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। একটি এয়ারলাইনস পরিচালনার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনা দরকার, পেশাদারত্ব দরকার, দক্ষ জনবল দরকার তা বিমানের নেই।’
বিমানের পরিচালন ব্যবস্থাপনা আমলানির্ভর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে অস্থায়ী ভিত্তিতে আমলারা আসেন। কিছুদিন কাজ করার পর তারা চলে যান। এতদিনেও বিমানের নিজস্ব কোনো পেশাদার দল গঠন হয়নি। বিমান যেহেতু একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এটাকে বাণিজ্যিকভাবেই চলার সুযোগ দিতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো চালালে সংস্থাটিতে কখনই সফলতা আসবে না।’
সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে উড়োজাহাজ পরিচালনা করেও খুব একটা মুনাফা করতে পারছে না বিমান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন পরিষেবা দিয়ে বিমানের মুনাফা হয়েছিল ২৮২ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে মুনাফা ছিল ২৮ কোটি টাকা। চলতি হিসাবে মুনাফা দেখালেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা দায় ও দেনায় ডুবে রয়েছে বিমান। বিমানবন্দর ও আকাশসীমা ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন চার্জ ও ফি বাবদ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও জেট ফুয়েলের দাম বাবদ পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের কাছে এ দেনা রয়েছে সংস্থাটির।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণবিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন করে। বিমান পাঁচ দশক ধরে কাঙ্ক্ষিত পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটিকে প্রয়োজনে ভেঙে নতুন আরেকটি এয়ারলাইনস গঠনের প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। এ টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এয়ারলাইনস ইন্ডাস্ট্রিতে বিমানকে প্রতিযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিশ্চিত করার জন্য সরকার সংস্থাটিকে পরিষ্কার ও পরিমাপযোগ্য লক্ষ্য বেঁধে দেবে। লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে বিমানের সমান্তরালে সংস্থাটির অর্ধেক সম্পদ ও জনবল দিয়ে নতুন আরেকটি এয়ারলাইনস গঠন করা হবে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বিমানের করণীয় কী হবে তা জানতে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান, এ মন্ত্রণালয়ের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব ফাতেমা রহিম ভীনা ও বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সাফিকুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ভাড়া নিয়ে বিমান বাংলাদেশের প্রতি যাত্রীদের অসন্তোষ অনেক দিনের। অনেক রুটে বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনসগুলোর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা যায় বিমান বাংলাদেশের টিকিট। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে গত কয়েক বছরে অনেকবার অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রবাসীরা বিপাকে পড়েছেন। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়।
বিমান ভালো করতে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অর্থনীতির অনেক দেশের এয়ারলাইনসও ভালো করছে। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। দেশটির রাষ্ট্রীয় আকাশ পরিবহন সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস স্কাইট্র্যাক্সের র্যাংকিংয়ে ২০২৫ সালে বিশ্বের ৩৮তম সেরা এয়ারলাইনস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে ঢাকা-আদ্দিস আবাবা রুটে ফ্লাইট পরিচালনাও শুরু করেছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস।