Image description
নিরাপত্তা সঞ্চিতি গঠন না করার কৌশল

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ২০২৪ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরে কাগজে-কলমে লাভ দেখালেও বাস্তবে লোকসানে ডুবে আছে—এমনই তথ্য উঠে এসেছে নিরীক্ষকদের প্রতিবেদনে।

ব্যাংকটির প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ হিসাব বছরের জন্য শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা দেখানো হয়েছে ৫ পয়সা, মোট ৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। কিন্তু নিরীক্ষকরা হিসাব কষে দেখেছেন, একই সময়ে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৫ টাকা ৮ পয়সা, অর্থাৎ নিট লোকসানের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার বেশি।

নিরীক্ষকদের ব্যাখ্যা হলো, ইউসিবি বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের বিপরীতে নিয়ম অনুযায়ী যে সঞ্চিতি গঠন করার কথা, তার বড় অংশই গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ও অগ্রিম বিতরণ করেছে মোট ৫৭ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা শ্রেণীকৃত ঋণে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক আইন অনুযায়ী এই খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখা দরকার ছিল ৬ হাজার ৫৫ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ইউসিবি রাখতে পেরেছে মাত্র ২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার মতো। সঞ্চিতি না দেখানোর কারণে লাভ দেখানো সম্ভব হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ব্যাংকটি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) প্রায় ১৫৫ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রেখেছিল, যার মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হলেও এখনো সেই টাকা ফেরত পায়নি। এই টাকা আদৌ ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও নিরীক্ষকদের সন্দেহ আছে। অথচ এই বিপজ্জনক ডিপোজিটের বিপরীতে ইউসিবি কোনো সঞ্চিতি রাখেনি।

এ ছাড়া ইউসিবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা সাবসিডিয়ারি ফিনটেক কোম্পানি ‘উপায়’-এর লোকসানও ব্যাংকের ওপর বড় চাপ ফেলেছে। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপায়ের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর এই কোম্পানির ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মালিকানা ইউসিবির হাতে। অর্থাৎ এ ক্ষতি সরাসরি ইউসিবির ঘাড়েই পড়ছে। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদনে এ লোকসান সঠিকভাবে প্রতিফলিত করা হয়নি।

সব মিলিয়ে ইউসিবি মোট ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার বেশি সঞ্চিতি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে বলে নিরীক্ষকরা উল্লেখ করেছেন। একই তথ্য চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। চলতি বছরের ২১ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউসিবিকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, তারা ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার সঞ্চিতি ঘাটতিতে রয়েছে এবং এটিকে অনুমোদনও করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড মেনে চলার জন্য ইউসিবির মূলধন থাকা দরকার ৬ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংকের হাতে মূলধন ছিল ৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূলধনের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৭২ কোটি টাকার মতো। এ ঘাটতির সঙ্গে সঞ্চিতি ঘাটতি যোগ করলে ইউসিবির মোট ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

এর ফলে ইউসিবির মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিআরএআর) অনেক নিচে নেমে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী এ অনুপাত থাকা উচিত ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, কিন্তু ইউসিবির অনুপাত দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সঞ্চিতি ঘাটতি বিবেচনায় আনলে এ অনুপাত নেমে আসে মাত্র ৫ দশমিক ৪০ শতাংশে, যা রেগুলেটরি মানদণ্ডের তুলনায় অনেক কম।

এদিকে ইউসিবি নিয়ে আরেকটি বড় অভিযোগ হলো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুটপাট। গত বছরের ডিসেম্বরে ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ সরাসরি অভিযোগ করে যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবার ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে চিঠিও পাঠায়।

চিঠিতে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ২০১৮ সালে ব্যাংকের আগের পর্ষদকে সরিয়ে নিজের পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। স্ত্রী রুখমিলা জামানকে চেয়ারম্যান এবং ভাই আনিসুজ্জামানকে নির্বাহী কমিটির প্রধান বানান। এরপর ব্যাংক থেকে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান—জেনেক্স ইনফোসিস, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার ও এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেটের নামে দ্রুত ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করা হয়। এসব ঋণের বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়।

দুদক এরই মধ্যে অনুসন্ধান শেষে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন ও আত্মসাতের ঘটনায় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলাটি দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে দায়ের করা হয়েছে। বাদী হয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শোয়াইব ইবনে আলম।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘আরামিট গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয় সৈয়দ নুরুল ইসলামকে ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স নামের একটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজানো হয়। এরপর জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ইউসিবির জুবিলি রোড শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়।’ বেআইনিভাবে ঋণ নেওয়ার জন্য এই হিসাব খোলা হয় বলে দুদক কর্মকর্তারা জানান।

অন্যদিকে ইউসিবির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদকে এ বিষয়ে ফোন ও মেসেজ পাঠালেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কোম্পানি সচিব পুলক চৌধুরীর যোগাযোগ নম্বরও পাওয়া যায়নি। ফলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য মেলেনি।

একটি শীর্ষ ব্যাংকিং হাউসের সিইও কালবেলাকে বলেন, ‘ইউসিবির অবস্থা যে খারাপ, এটা সবাই জানে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা স্পষ্ট—লাভ বা লোকসানের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হবে। আজ তারা লাভ দেখালেও কাল তা ফাঁস হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারীরা সাময়িকভাবে মুনাফা দেখে হয়তো ঝুঁকবেন, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিশ্চিত। এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমাদের বাজার থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।’

অর্থাৎ কাগজে লাভ দেখালেও, বাস্তবে ইউসিবি লোকসানের ভেতরে ডুবে আছে। লোকসান আড়াল করে লাভ দেখানোর এ চর্চাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।