
ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ কারণে ভূউপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়াতে ২০১৪ সালে ‘ঢাকা পরিবেশবান্ধব টেকসই পানি সরবরাহ’ প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেয় ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা)। তিন উন্নয়ন সংস্থার ঋণে নেওয়া প্রকল্পটি পাঁচ বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও প্রায় এক যুগেও শেষ হয়নি কাজ। এর মধ্যে তিন ধাপে ব্যয় বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প ১০ হাজার ৯৭৩ কোটিতে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা ঢাকতে বিভিন্ন সংস্থার ওপর দোষ চাপাচ্ছে ওয়াসা।
সূত্র জানায়, ‘ঢাকা পরিবেশবান্ধব টেকসই পানি সরবরাহ’ শীর্ষক প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবটি আজ রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ব্যয় বাড়ানোর কারণ হিসেবে ওয়াসার দাবি, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার সংস্থা যেমন- মেট্রোরেল, ডিএনসিসি, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, ডেসকো, রাজউক, জলসিঁড়ি এবং ফাইবার অপটিকসের কারণে প্রকল্পটির উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। উল্টো এসব কারণে একটি খাতে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। ওয়াসার দাবি, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউটিলিটি শিফটিং, পাইপলাইনের রুট ও ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৭০৬ কোটি ৫৫ কোটি টাকা (২৫ শতাংশ)।
ঢাকার কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের পানি সংকট নিরসনের স্বপ্ন নিয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়েছিল ‘ঢাকা পরিবেশবান্ধব টেকসই পানি সরবরাহ’ প্রকল্প। মেঘনা নদী থেকে পানি এনে নারায়ণগঞ্জের গন্ধর্বপুরে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার সক্ষমতার বিশাল শোধনাগার নির্মাণ করে রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টা পরিশোধিত পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনায় ছিল মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগেই প্রকল্প শেষ হবে এবং তাতে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে একেবারে উল্টো। পাঁচ বছরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি প্রায় এক যুগেও।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় প্রকল্পের ব্যয় অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা লাগছে। মেয়াদও টেনে নেওয়া হচ্ছে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। তৃতীয়বারের মতো সংশোধিত প্রস্তাব একনেকে তোলা হচ্ছে রোববার (আজ)। আর এসবের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের গলদ ও সমন্বয়হীনতার চিত্র।
ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিগুণ ও দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি
পরিকল্পনা কমিশনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ব্যয় বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ ডলারের বিনিময়হার বেড়ে যাওয়া। অনুমোদনের সময় প্রতি ডলার ছিল ৮৪ টাকা, এখন তা দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। ফলে বাড়তি খরচ হয়েছে এক হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রানির্ভর প্রকল্পে এ ধরনের পরিবর্তন ছিল অনুমেয়। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু তা না থাকায় অতিরিক্ত এ ব্যয় এখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রকল্পের পাইপলাইনের রুট পরিবর্তন এবং ডিজাইন সংশোধনের পেছনে মূল কারণ বিভিন্ন অবকাঠামো সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব। মেট্রোরেল, রাজউক, সড়ক-মহাসড়ক, ডেসকো এবং তিতাসের মতো সংস্থাগুলোর সঙ্গে শুরুর দিকে সমন্বয় করলে পরবর্তী সময়ে রুট পরিবর্তন ও পুনঃকাজের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু তা না হওয়ায় ইউটিলিটি স্থানান্তর ও নকশা পরিবর্তনে খরচ বেড়েছে আরো ৭০৬ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রকল্পে ঠিকাদারি চুক্তি করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এফআইডিআইসি শর্তে। এতে বিলম্ব সুদ ও প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টের ধারা ছিল, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় সক্রিয় হয়েছে। এর ফলে শুধু এ দুই খাতেই খরচ বেড়েছে ৪২৩ কোটি টাকা। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সময়সূচি মেনে কাজ সম্পন্ন না হওয়া এবং চুক্তি বাস্তবায়নে ত্রুটি এ বাড়তি ব্যয়ের অন্যতম কারণ।
সরকারি রাজস্বনীতির পরিবর্তনের ফলে কর, ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধিতে ব্যয় বেড়েছে আরো ৩৭০ কোটি টাকা। পাশাপাশি সড়ক খনন চার্জ বাড়ানো, শোধনাগারে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য নতুন করে সোলার প্যানেল স্থাপনসহ বিভিন্ন পরিচালন খাতে গেছে অতিরিক্ত ১৪১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ প্রশাসনিক জটিলতা। জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, পুনর্বাসনকাজে বিলম্ব, উন্নয়ন সহযোগী ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের অর্থছাড়ে জটিলতা এবং রাস্তা কাটার অনুমতি নিতে মাসের পর মাস অপেক্ষা। এসব কারণে বহুবার কাজ থমকে গেছে। এমনকি ঠিকাদারদের সাইট হস্তান্তরে বিলম্ব হওয়ায় কিছু চুক্তি নির্ধারিত সময়ে শুরুই হয়নি। প্যাকেজ ৩.১ ও ৩.২-এর কাজের জন্য পাইপলাইন রুট পরিবর্তন ও নতুন নকশা অনুমোদন পেতেও সময় লেগেছে দীর্ঘদিন।
স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা
২০১১ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে করা একটি ফিজিবিলিটি স্টাডিতে খিলক্ষেতে এক হাজার এমএলডি ক্ষমতার শোধনাগারের প্রস্তাব ছিল। পরে তা পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জের গন্ধর্বপুরে ৫০০ এমএলডি শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৪ সালে একনেকে অনুমোদনের সময় প্রতিশ্রুতি ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার পানি সংকট অনেকটা দূর হবে। কিন্তু প্রায় এক যুগ হতে চললেও রাজধানীর মিরপুর, বাড্ডা, গুলশান, উত্তরা, মতিঝিলসহ বহু এলাকায় পানি সংকট আগের মতোই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ৮৯ শতাংশ ভৌতকাজ সম্পন্ন হলেও পূর্ণ সুফল পেতে আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানির সংকট ও প্রকল্পের লক্ষ্য
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ৭০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকার মতিঝিল, উত্তরা, বনানী, খিলক্ষেত, বাড্ডা ও মিরপুরসহ বিস্তৃত এলাকায় গভীর নলকূপই প্রধান উৎস। পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে এক মিটার করে নিচে নামছে। দূষণের কারণে শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। তুলনামূলক পরিষ্কার মেঘনা নদীকে তাই স্থায়ী উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
৫০ কোটি লিটার দৈনিক ক্ষমতার শোধনাগার নির্মাণ হলে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীসহ রাজধানীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ১২ শতাংশ ছাড়ের হারে আর্থিক অভ্যন্তরীণ মুনাফার হার দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক মুনাফার হার প্রায় ১৫ শতাংশ। তবে সেটি ছিল প্রাথমিক ব্যয় ও সময়সূচির ওপর ভিত্তি করে।
আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে জনগণের ভোগান্তি
প্রকল্প খরচ প্রায় দ্বিগুণ এবং সময়সীমা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার সময় পিছিয়ে গেছে কয়েক বছর। এতে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপ বহুগুণ বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে যেটিকে লাভজনক ধরা হয়েছিল, বাস্তবে সে লাভ এখন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ায় জনগণও ভোগান্তিতে পড়েছে। পানি সংকট আগের মতোই রয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো নেমে গেছে। প্রকল্প সময়মতো শেষ হলে অন্তত পাঁচ বছর আগে মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলার চাপ কমানো যেত।
এখন প্রশ্ন উঠছে- এ বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধির দায় কে নেবে? সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা, প্রকল্প পরিচালনায় গাফিলতি এবং প্রশাসনিক জটিলতার বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই বহন করতে হবে। বাড়তি ব্যয়ের অর্থ আসবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও ঋণ থেকে, যার সুদও করদাতাদের কাঁধেই পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে প্রাথমিক পরিকল্পনা ও সমন্বয় দুর্বল হলে শুধু ব্যয়ই বাড়ে না, জনগণও প্রতিশ্রুত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে জমি অধিগ্রহণ ও অনুমতি প্রক্রিয়া শুরুর দিকে শেষ না করায় সময়ক্ষেপণ হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা না থাকায় ব্যয় বেড়েছে বিপুল পরিমাণে।
পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা এ প্রকল্প এখন সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের অব্যবস্থাপনা শুধু করদাতাদের অর্থ নষ্ট করে না, ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করে। উন্নয়ন সহযোগীরাও এ ধরনের বিলম্বকে ঝুঁকি হিসেবে দেখে, যা ভবিষ্যতে ঋণ বা অনুদানপ্রাপ্তিকে কঠিন করে তুলতে পারে।