
ঝুঁকি বিবেচনায় লাল তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংক পিএলসিতে ঘটেছে গুরুতর অনিয়ম ও ব্যাপক লুটপাট । আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করে তা আদায়ে খাবি খাচ্ছে ব্যাংকটি । খেলাপি ঋণ হয়ে পড়েছে লাগামছাড়া । এতে ব্যাংকের সম্পদের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে । এবি ব্যাংকের সমন্বিত মূলধন দেখানো হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা ।
ব্যাংকিং নীতিমালার ব্যাসেল -৩ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ( রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট ) দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা । বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে । বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন , এবি ব্যাংকের অনিয়মের শেষ নেই । ব্যাংকটিতে ঋণ নীতিমালার ব্যাপক অনাচার ঘটেছে । আগ্রাসী ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে পারছে না । ঋণের জামানত ঠিকঠাক নেই । আর ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে হাবুডুবু খাচ্ছে । মোট ঋণকে ছাড়িয়ে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ । ঝুঁকি বিবেচনায় নতুন ঋণ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক । এখন ব্যাংকটির অগ্রগতি নিয়ে আশার কিছু নেই । আর কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে । বিষয়টি পরে পরিষ্কার করা হবে ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি বছরের হালনাগাদ পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে , ২০২৩ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এবি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়ম উঠে এসেছে । ব্যাংকটি বিশেষ বিবেচনায় ১১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ নিয়মিত দেখিয়েছে , যা আইনে ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হিসেবে দেখানো প্রয়োজন ছিল । আর ঝুলে থাকা মামলায় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ( রিস্ক ওয়েটেড ) ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকাও খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি । এই দুই খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পত্তি ১৩ হাজার ৫৮৪ কোটি খেলাপি সত্ত্বেও নিয়মিত দেখানো গুরুতর অনিয়ম হিসেবে দেখছেন পরিদর্শকেরা ।
এমন ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে ২০ শতাংশের কম প্রভিশন সংরক্ষণ করায় দেড় গুণ জরিমানাসহ ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ দাঁড়ায় ২০ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বকেয়া ঋণ বিবেচনায় ( স্পেশাল হিসেবে ও খেলাপি ) একক ও সমন্বিত ঋণ হিসেবে ৩৭ হাজার ৯৯ কোটি টাকার সঙ্গে যোগ হয় । পরিশেষে ব্যাংকটির একক ও সমন্বিত হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা । আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নীতিমালার মানদণ্ড ব্যাসল -৩ গাইড লাইন অনুযায়ী , ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের ( রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট ) নির্ধারিত ২০ ২০ শতাংশের কম প্রভিশন সংরক্ষণ করলে সে ক্ষেত্রে বকেয়ার জন্য ১৫০ শতাংশ হারে প্রভিশন হিসাব করতে হবে । এবি ব্যাংকের বকেয়া প্রভিশনের জন্য সম্পদের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেশি হয়েছে ।
এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও বিভিন্ন শাখা ঘুরে জানা গেছে , এবি ব্যাংক ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক । ভালোভাবেই চলছিল ব্যাংকটি । কিন্তু ২০১৭ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয় । এতে ব্যাংকটিতে একটা বড় ধাক্কা লাগে । পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক । কিন্তু পরিস্থিতি যেন যেই লাউ সেই কদু । ঋণ বিতরণে ব্যাংকিং নীতি উপেক্ষার অনেক ঘটনা ঘটে । বিশেষ করে বেক্সিমকো গ্রুপ , সিকদার গ্রুপ , এশিয়ান সিটি , বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও মাহিন গ্রুপের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া হয়ে পড়ে । এসব ঋণ আদায়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এবি ব্যাংক ।
আর গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ৩৩ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি দেখানো হয়েছে ৮ হাজার ৮৪০ কোটি বা ২৬ শতাংশ । প্রকৃত খেলাপি ৫০ শতাংশের বেশি বলে জানান খোদ ব্যাংকটির কর্মকর্তারা । এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ( টিআইবি ) নির্বাহী পরিচালক ড . ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ব্যাংকে ঋণের নামে লুটপাট হয়েছে । কিছু ব্যাংক ফাঁকা হয়েছে । কিছু ব্যাংক ঝুঁকি বিবেচনায় লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে । অনেক ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । তাহলে এসব ব্যাংক কার্যত ব্যাংকিং করছে না । ঘুরে দাঁড়াবে সে রকমটা দেখা যাচ্ছে না । দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছেছে ।
কারা অপকর্মে জড়িত , তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এবিসহ ঝুঁকিতে থাকা সব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এবি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের রক্ষিতব্য সংস্থান ( মার্জিন ঋণের বিপরীতে ) ৪৭৫ কোটি টাকা , যার বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয় মাত্র ৩৪ কোটি টাকা । সেখানে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪১ কোটি টাকা । আর এবি সিকিউরিটিজ লিমিটেডোর প্রয়োজনীয় রক্ষিতব্য সংস্থান ( মার্জিন ঋণের বিপরীতে ) ৪৪ কোটি টাকা । যার বিপরীতে রক্ষিত সংস্থান পাওয়া গেছে মাত্র ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা । এখানে ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকা । পাশাপাশি নিজস্ব বিনিয়োগ ও মার্জিন ঋণের বিপরীতে রক্ষিত সংস্থান ঘাটতি ৪৭০ কোটি টাকা । তবে সর্বমোট সংস্থান ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর খান বলেন , “ দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংকটি নির্দিষ্ট ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে । তবে বিগত সরকারের সময়ে কিছু নীতির ব্যাঘাত ঘটেছে । আমরা সবকিছু ভালো করার চেষ্টা করছি । গ্রাহকেরা টাকা পাচ্ছে । কোনো গ্রাহক চেক দিয়ে টাকা পায়নি সে রকম একটি নজিরও নেই । আমানত বাড়ছে । ' ব্যাংকটির বিপুল সম্পদ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন , ‘ কবে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না । ’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে , ঝুঁকির শীর্ষে থাকায় বিগত সরকারের সময় লাল তালিকাভুক্ত ছিল এবি ব্যাংক । এরপর দিন দিন অবস্থার আরও অবনতি ঘটে । আর ঋণের নামে ব্যাংক খালির ঘটনায় ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক । এর আগে ১৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি গোপন করেছিল ব্যাংকটি । প্রভিশন ঘাটতি ছিল । বারবার দিতে হয়েছে জরিমানা । সবশেষে বেড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ , যা নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ । এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড . মইনুল ইসলাম বলেন , সরকারের উচিত ব্যাংকের ওপর নিরপেক্ষ অডিট নিরীক্ষা ) করা । এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত না । তাহলে কারা ব্যাংক খালি করল , তাদের নাম বের হয়ে আসবে । তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে । চিহ্নিত বড় খেলাপিদের সম্পদ ক্রোক করতে হবে । আর যেসব ব্যাংক তা করবে না , তাদের বিরুদ্ধে হার্ড লাইনে ( কঠোর অবস্থান ) যেতে হবে ।