Image description

বর্ষা মৌসুম দক্ষিণ এশিয়ায় আবারও নিয়ে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। মেঘ ভাঙনের কারণে পাকিস্তান ও ভারতের উত্তরাঞ্চল টানা ভারি বর্ষণ, আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি ও পার্বত্য এলাকায় হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বহু গ্রামীণ অবকাঠামো, প্রাণ হারিয়েছেন উভয় দেশের শত শত মানুষ।

 

ভারতে বিপর্যয়ের চিত্র

ভারতের জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে নদ-নদী উপচে পড়েছে। তীব্র স্রোতে সেতু, সড়ক ভেঙে গেছে; হাজারো মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ভাঙন ও ভূমিধসের ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠেছে পুরো অঞ্চলজুড়ে। এনডিটিভির খবরে বলা হয়, রোববার (১৭ আগস্ট) কাঠুয়া জেলায় দুটি পৃথক ঘটনায় অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে।

এর আগে চলতি সপ্তাহেই কিশতোয়ার জেলায় মেঘ ভাঙনের ফলে আকস্মিক বন্যায় অন্তত ৫০ জনেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। কমপক্ষে ৮২ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

পাকিস্তানে বিপর্যয়ের চিত্র

 

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের থেকে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া ও গিলগিত-বালতিস্তানে ভূমিধস এবং আকস্মিক বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। দেশটির এই প্রদেশগুলোর বহু গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষিজমি ডুবে গেছে এবং বিদ্যুৎ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

ফলে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল ভয়াবহ বন্যা ও প্রবল বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত। গত দুইদিনে নিহতের সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে খাইবার পাখতুনখোয়া (কেপি) প্রদেশে। অঞ্চলটিতে নিহতের সংখ্যা ৩১৩ জনে পৌঁছেছে। গিলগিট-বালতিস্তান (জিবি) এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরে (এজেকে) মৃত্যু হয়েছে আরও অন্তত ২৩ জনের। প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (পিডিএমএ) তথ্যমতে, কেবল কেপিতেই নিহতদের মধ্যে ২৬৩ জন পুরুষ, ২৯ জন নারী ও ২১ জন শিশু।

ভারী বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি। জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫৯টি বাড়ি ধ্বংসের খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে রয়েছে সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাঙলা ও বাটগ্রাম। আরও তীব্র বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া বিভাগ (পিএমডি), যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কেপির বুনার জেলার বেশন্ত্রি গ্রামে পরিস্থিতি বিশেষভাবে মর্মান্তিক। আকস্মিক বন্যায় গ্রামটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে—একটিও বাড়ি অক্ষত নেই। এত মানুষের মৃত্যুতে দাফনের জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যায়নি। মৃতদেহ দাফনে পাশের গ্রামের মানুষদের এগিয়ে আসতে হয়েছে। 

বেশন্ত্রি গ্রামে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষও। গ্রামবাসীরা জানান, দুপুরে গ্রামে পৌঁছেই তারা দেখেন একটিও ঘর অক্ষত নেই, সর্বত্র বন্যার ধ্বংসস্তূপ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি যে তা পূরণ করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ত্রাণ সরবরাহ করতে গিয়ে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনাও ঘটেছে। এতে দুই পাইলটসহ পাঁচজন নিহত হন।

কীভাবে মেঘ ভাঙন এত ধ্বংস ঘটালো

পাকিস্তান ও ভারতে এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগে হয়তো দেখেনি অঞ্চলগুলোর মানুষ, যে দুর্যোগ শুধু পাকিস্তানেই দুই দিনে সাড়ে ৩০০ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আকস্মিক দুর্যোগের মূল কারণ হলো মেঘ ভাঙন (Cloudburst)। সাধারণ বৃষ্টিপাতের তুলনায় মেঘ ভাঙনে অতি অল্প সময়ে ভয়াবহ পরিমাণ বৃষ্টি নামে।

এই মেঘ ভাঙনের কারণেই হিমালয় থেকে কারাকোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় প্রবল বর্ষণ, আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসে পাকিস্তান ও ভারতের শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড থেকে শুরু করে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া, গিলগিট-বালতিস্তান ও আজাদ জম্মু–কাশ্মীর—সব জায়গাতেই একই ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

মেঘ ভাঙনের বৈজ্ঞানিক কারণ

মেঘ ভাঙন মূলত পাহাড়ি এলাকায় ঘটে, যেখানে আর্দ্র বাতাস পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে দ্রুত উপরে উঠে যায়। উচ্চতায় পৌঁছে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি করে ঘন মেঘ। সাধারণ বৃষ্টির মতো ধীরে ধীরে পানি ঝরার বদলে মেঘের ভেতর বিপুল জলকণা হঠাৎ ভেঙে পড়ে যায়।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অথবা এক মাস বা তারও বেশি সময় হতে পারে বৃষ্টিপাত, ফলে ছোট ছোট নদী ও খাল হঠাৎই ভয়ংকর বন্যায় রূপ নেয়। এই প্রবল বৃষ্টি পাহাড়ি মাটি নরম করে দেয়, ফলে দেখা দেয় ভূমিধস।

ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কেন এত বেশি

ভারত ও পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি, রাস্তা ও অবকাঠামো এখন অনেক ঘনবসতিপূর্ণ। খাড়া ঢালে বাড়িঘর নির্মাণ এবং বন উজাড়ের ফলে ভূমি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অার এ কারণে মেঘ ভাঙনের পর বৃষ্টির পানি একদিকে বন্যার সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে পাহাড় ধসে পড়ছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় দুর্গম এসব অঞ্চলে পাহাড়ি একমাত্র রাস্তা অন্য অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করে। ফলে ভূমিধস ও বন্যায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উদ্ধারকর্মীদের সেখানে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। আবার পাহাড় ও বৈরী আবহাওয়া হওয়ায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালানোও অনেক চ্যালেঞ্জিং।

আর এসব কারণেই পাকিস্তান ও ভারতে এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে  উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট ভেঙে পড়ায় দুর্গত এলাকায় খাদ্য ও চিকিৎসা পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মানবিক সংকট

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলে মেঘ ভাঙনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্প জমার প্রবণতা বেশি হচ্ছে। এর ফলে অল্প সময়ে অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বরফগলা পানি যোগ হয়ে আরও ভয়াবহ করে তুলছে হিমালয় ও কারাকোরাম অঞ্চলের পরিস্থিতি।

এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুই দেশে একইসঙ্গে ভয়াবহ মানবিক সংকটও তৈরি করেছে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ায় অনেক গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও মৃতদেহ দাফনের লোকও পাওয়া যায়নি।

ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে তীর্থযাত্রীসহ বহু মানুষ আকস্মিক বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন, শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা ও পরিকল্পিত নগরায়ণ না করলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে এই মেঘ ভাঙন।

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন পাকিস্তানের বর্ষাকে আরও অনিয়মিত, মেঘ বিস্ফোরণকে আরও হিংস্র এবং হিমবাহ গলে যাওয়াকে আরও ধ্বংসাত্মক করে তুলছে। যদিও কোনো প্রশাসন বা সরকার চাইলে বৃষ্টি থামাতে পারে না, তবুও বেশিরভাগ ট্র্যাজেডি মানুষের ব্যর্থতার কারণেই ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনার অভাব এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় ভবন নির্মাণের বিধিনিষেধের দুর্বল প্রয়োগ রয়েছে। এছাড়া দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাগুলোর কাঙ্ক্ষিত সহায়তা সরবরাহের ঘাটতির বিষয়টিও এই ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার জন্য উল্লেখযোগ্য কারণ।