Image description

স্লোগানটির শুরু ‘১, ২, ৩, ৪’ দিয়ে। পরের অংশের শেষ শব্দগুলো অশ্লীল। এতটাই অশ্লীল যে ভদ্রসমাজে তা মুখে আনা যায় না।

কথায় অশ্লীল কিছু থাকলে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম একটা কৌশল ব্যবহার করে। অশ্লীল শব্দের জায়গায় সাংকেতিক আওয়াজ (টুট-টুট) শোনানো হয়। শ্রোতারা যা বোঝার বুঝে নেন।

অশ্লীল শব্দ লেখাও অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে পাঠ্যমাধ্যমে অশ্লীল শব্দের জায়গায় ‘...’ ব্যবহার করা হয়। পাঠক বুঝে নেন, এখানে অশ্লীল কিছু আছে।

লাল চাঁদের হত্যার প্রতিবাদে ১১ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে মিছিল হয়। এসব মিছিলের কোনো কোনোটিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিশানা করে ‘১, ২, ৩, ৪’ বলে অশ্লীল স্লোগান দিতে দেখা যায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির কাছে বর্তমানের অশ্লীল স্লোগানগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। চ্যাটজিপিটির উত্তর, ‘আগেই বলে রাখি, যেহেতু এগুলো আসলেই অশ্লীল ও অপমানজনক, আমি সেগুলো শব্দ লিখব না। বরং আংশিক সেন্সর করে দেব, যাতে গবেষণা বা তথ্যসূত্র হিসেবে বোঝা যায়।’

বাংলাদেশে অশ্লীল স্লোগান কবে থেকে দেওয়া শুরু হলো, আর কী কারণেই-বা এমন স্লোগান দেওয়া হয়, সে বিষয়ে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের শিক্ষক ফাহমিদুল হকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্লোগানে গালির প্রথম উপস্থিতি দেখা যায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে। সারা পৃথিবীর জেন–জিরা নিজেদের প্রকাশভঙ্গির প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যে গালি ব্যবহার করে। আগের জেনারেশনের জন্য বিষয়টা অবশ্যই অস্বস্তিকর। তবে অন্য সৃজনশীল স্লোগানের পাশাপাশি প্রকাশভঙ্গিতে খানিকটা গালির ব্যবহার বাড়তি ক্রোধ প্রকাশে সহায়ক হয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘন ঘন এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি আর লুকিয়ে রাখা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নেই; বরং তা অস্বস্তিকর থেকে বিরক্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

সারা পৃথিবীর জেন–জিরা নিজেদের প্রকাশভঙ্গির প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যে গালি ব্যবহার করে। আগের জেনারেশনের জন্য বিষয়টা অবশ্যই অস্বস্তিকর। তবে অন্য সৃজনশীল স্লোগানের পাশাপাশি প্রকাশভঙ্গিতে খানিকটা গালির ব্যবহার বাড়তি ক্রোধ প্রকাশে সহায়ক হয়। তবে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘন ঘন এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি আর লুকিয়ে রাখা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে নেই; বরং তা অস্বস্তিকর থেকে বিরক্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ফাহমিদুল হক, যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের শিক্ষক

রাজধানীর পুরান ঢাকায় গত ৯ জুলাই ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) নৃশংসভাবে হত্যা করে একদল লোক। পরে এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তখন এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়। পাঁচ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারের কথা জানায় বিএনপি।

লাল চাঁদের হত্যার প্রতিবাদে ১১ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে মিছিল হয়। এসব মিছিলের কোনো কোনোটিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিশানা করে ‘১, ২, ৩, ৪’ বলে অশ্লীল স্লোগান দিতে দেখা যায়।

এ ধরনের অশ্লীল স্লোগান যাঁরা দেন, তাঁরা আসলেই সাধারণ শিক্ষার্থী কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে চলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।

গত ১৪ জুলাই রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, লাল চাঁদ হত্যার ঘটনা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্লোগানের বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অশ্লীল বা অশোভন স্লোগানের বিষয়টি আসলে রাজনীতির সংঘাতময় সংস্কৃতিরই অংশ। অশ্লীল স্লোগান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও তা বন্ধের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

১৭ জুলাই ময়মনসিংহে এক সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘আমি ব্যথিত হয়েছি, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা তারেক রহমানকে নিয়ে এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন কীভাবে? এটা কোনো রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। এটা কোনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না।’

তারেক রহমানকে নিয়ে অশ্লীল স্লোগান দেওয়ার পর সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি ফেসবুক পোস্টে লেখেন, যে ধরনের অশ্লীল-অশ্রাব্য স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তার পরিণতি ভালো হবে না।

অন্যদিকে অশ্লীল স্লোগান নিয়ে ফেসবুকে অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি লেখেন, আগে স্লোগান শুনলেই দেশের জন্য মন উত্তাল হয়ে উঠত। বিভিন্ন দলের আদর্শ প্রকাশ পেত মিছিল ও স্লোগানে। কিন্তু এখন স্লোগান শুনলে দ্রুত ফোনের সাউন্ড বন্ধ করে চারপাশে কেউ আছে কি না দেখে নিতে হয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্লোগানের বিষয়টি রাজনৈতিক দলের নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অশ্লীল বা অশোভন স্লোগানের বিষয়টি আসলে রাজনীতির সংঘাতময় সংস্কৃতিরই অংশ। রাজনৈতিক সহিংসতার প্রভাব ভাষার ওপরে পড়ে। অশ্লীল স্লোগান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও তা বন্ধের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক সহিংসতা চলমান থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সবকিছুর ওপর। অশ্লীল স্লোগান সেটিরই বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ায় অশ্রাব্য, অশ্লীল কথার ব্যবহার বেশি হারে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশপ্রেম রয়েছে, পড়াশোনার মাধ্যমে শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা করতে চান—এমন তরুণদের রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন।
মনিরুল আই খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক

এদিকে রাজনীতির মাঠ ছাড়িয়ে অন্যত্রও অশ্লীল স্লোগান ব্যবহারের নজির দেখা যায়। যেমন এজলাস চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন জেলা জজের বিরুদ্ধে কতিপয় আইনজীবীর অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি এক শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘অশ্লীল স্লোগান! কমলাপুরের কুলিরাও তো এমন করে না। এটি কোনো ভাষা?’

স্লোগান সময়কে তুলে ধরে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কালজয়ী নানান স্লোগানের জন্ম হয়েছে।

গত বছরের ১২ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বারুদ হয়ে ওঠা স্লোগানগুলো’ শিরোনামের প্রতিবেদনে শত বছর আগের একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। সে সময় আইন করে এই বাংলায় ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান নিষিদ্ধ করেছিল ব্রিটিশরা। এর প্রতিবাদ জানাতে তৎকালীন বাখেরগঞ্জ জেলার (বর্তমানের বরিশালের অংশ) নারীরা চুল বাঁধা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শিশির কর সম্পাদিত ‘ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই’-এ এক প্রবন্ধে এই ঘটনার বর্ণনা আছে।

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে এমন সব স্লোগানের জন্ম হয়, যা ছাত্র-জনতাকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে রাজপথে নেমে আসতে। এসব স্লোগানের মধ্যে ছিল—‘লাখো শহীদের দামে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে, কী করছে কী করছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে’, ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়’, ‘এক দফা, এক দাবি, স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’, ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’—এই স্লোগানগুলোর জন্ম হয়েছে এ আন্দোলন থেকেই।

স্লোগানে গালির ব্যবহার না করে সৃজনশীল শব্দ-বাক্য ব্যবহার কাম্য বলে মত দেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের শিক্ষক ফাহমিদুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা এ বিষয়ে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল আই খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা চলমান থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সবকিছুর ওপর। অশ্লীল স্লোগান সেটিরই বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ায় অশ্রাব্য, অশ্লীল কথার ব্যবহার বেশি হারে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশপ্রেম রয়েছে, পড়াশোনার মাধ্যমে শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা করতে চান—এমন তরুণদের রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন।