Image description
মূল লক্ষ্য চিকিৎসাশিক্ষাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া

দেশের একাডেমিক ও সেবা হাসপাতাল পৃথক করার কথা ভাবছে সরকার। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই সবকটি হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের চিন্তা রয়েছে। মূলত মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে বড় এ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষ চিকিৎসা নেয়। আড়াই হাজার শয্যার হাসপাতাল হলেও রোগী ভর্তি থাকে দ্বিগুণের বেশি। বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপে বড় অংশ সামাল দিতে হয় প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের। জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে বহির্বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে নিয়মিত রোগী দেখতে হয় তাদের। কত জন রোগীকে পরামর্শ দিতে হবে, তার নির্দিষ্ট সীমা না থাকায় শিক্ষায় বিঘ্ন নিয়েই সেবা দেন তারা।

অন্যদিকে যে সেবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেওয়ার কথা, সেটি প্রশিক্ষণার্থীদের মাধ্যমে পাওয়ায় হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় রোগীদের। এতে সেবায় যতটা না নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চিকিৎসা শিক্ষাখাত। এমন পরিস্থিতিতে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে একাডেমিক ও সেবা হাসপাতাল পৃথক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে সরকারের নেওয়া এ পদক্ষেপকে যুগান্তকারী মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একাডেমিক ও সেবা হাসপাতাল আলাদা হবে- এটাই আদর্শ ব্যবস্থা। সে অনুযায়ী ল্যাব হিসেবে ধরে নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো করা হয়েছে। এমনকি পরবর্তী মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষা আলাদা করা হয়। কিন্তু বিগত সরকারের সদিচ্ছার অভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। এটি বাস্তবায়নে রোগীদের ভোগান্তি কমবে। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি বদলে যাবে মেডিকেল শিক্ষার ভঙ্গুর দশা।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রতি বছর ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন। এমবিবিসে এসব শিক্ষার্থীকে ১১টি বিষয়ে বেসিক শিক্ষা ও বাস্তবে হাতেকলমে শিখতে হয়। এছাড়া বড় একটি অংশ প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তথ্যমতে, দেশে সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা ৭১ হাজার ৬৬০টি। যেখানে প্রতি ৫০ জন মানুষের বিপরীতে শয্যার অনুপাত শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে স্বাস্থ্যখাতে অর্জন নিয়ে গত ৭ আগস্ট ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, দেশের সরকারি হাসপাতালের প্রায় প্রতিটিতেই শয্যার অতিরিক্ত রোগী থাকছে। কোনোটিতে আবার দ্বিগুণ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এসব হাসপাতালে ১৫ হাজার শয্যার ঘাটতি রয়েছে।

একদিকে রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবাপ্রাপ্তির অভাব, অন্যদিকে শিক্ষা কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটনায় সেবা ও একাডেমিক হাসপাতাল আলাদা করার উদ্যোগ বলে জানিয়েছ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডা. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘শিক্ষাদান বা প্রশিক্ষণ ও সেবা হাসপাতালের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে প্রতি বিভাগে ১০০ থেকে ২০০ রোগী দেখা হয়। যেখানে প্রতি রোগীকে সময় দেওয়া হয় সর্বোচ্চ তিন মিনিট। এটি আউটডোর সেবার জন্য আদর্শ না। চিকিৎসকরাও রোগীর চাপ সামলাতে এর চেয়ে বেশি সময় দিতে পারেন না। এসব চিকিৎসকের বড় অংশই প্রশিক্ষণার্থী, যাদের রোগী দেখার কথা অন্তঃবিভাগে, কিন্তু তাকে সামলাতে হচ্ছে বহির্বিভাগ। ফলে শিক্ষাটা তিনি ঠিকমতো পাচ্ছেন না। আউটডোরের পরিবেশটাও ঠিক রাখা যাচ্ছে না। ফলে উচ্চশিক্ষাটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।’

ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘৩৭টি মেডিকেল কলেজে আলাদা হাসপাতাল হয়তো করা যাবে না। আমাদের শয্যার চাহিদা প্রচুর, ১২ থেকে ১৫ হাজার রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নেয়। এ অবস্থায় বিছানার বাইরে রোগী ভর্তি করবে না- এমনটাও বাস্তবসম্মত হবে না। এজন্য যেসব মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সেবাও চালু রয়েছে- সেগুলোর একটা অংশ আলাদা করার চিন্তা করা হচ্ছে। এতে করে সত্যিকারার্থে শিক্ষার জন্য যতটুকু শয্যা দরকার ততটুকু হবে, বাকিগুলো সেবার আওতায় চলে যাবে।’

মেডিকেল শিক্ষাকে সর্বোচ্চ মানের করতে হলে সেবা ও একাডেমিক হাসপাতাল পৃথক করার বিকল্প নেই বলে মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. কামরুল আলম। সরকারের আন্তরিকতা থাকলে এক বছরের মধ্যে বিভাগীয় আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পৃথক করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢামেক অধ্যক্ষ বলেন, ‘সব বিভাগে না করে দু-একটিতে করলে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে। পুরো বাংলাদেশকে ২৫টি অঞ্চলে ভাগ করলে পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সমস্যা এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। এগুলো যতদিন না হবে, মানুষ সেবা না পাওয়ার জন্য চিকিৎসকদেরই গালি খেতে হবে।’

কামরুল আলম বলেন, ‘এমবিবিএস ডিগ্রির জন্য মূলত ১১টি বিষয় লাগে। সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা দিতে হলে প্রত্যেকটি বিষয়ে একজন অধ্যাপক, দুজন সহযোগী অধ্যাপক, তিনজন সহকারী অধ্যাপকসহ সাতজন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক লাগবেই। এর বাইরে প্রতিটি বিষয়ে প্রভাষক বা মেডিকেল অফিসার লাগে ১৫ জন করে। অন্যদিকে রোগী ঢাকামুখী হবে না, স্থানীয় পর্যায়েই বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা মিলবে- এটি নিশ্চিত করতে হলে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালে সাব স্পেশালিটি লাগবে ১২ হাজার ৪০০। এর বাইরে জুনিয়র চিকিৎসক লাগবে প্রায় ৪৫ হাজার। এছাড়া ৪৬৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন করে চিকিৎসকের ধরলেও সাত হাজার লাগে। সব মিলিয়ে সরকারি হাসপাতালে ৮০ হাজার চিকিৎসক লাগে। কিন্তু বর্তমানে রয়েছে ৩৫ হাজারের মতো। তার মানে এখনো প্রায় ৫০ হাজার পেছনে রয়েছি আমরা।’

লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলে এ উদ্যোগকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রায় ১৫ বছর লাগতে পারে জানিয়ে ঢামেকের অধ্যক্ষ বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে কোনো বড় মেডিকেলে গেলে কোনো বিভাগেই এ ফরম্যাটে জনবল নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক সময় আমাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, পদক্ষেপ নিলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আটকে যায়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এক বছরের মধ্যে পুরোনো আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পৃথক হাসপাতাল করা সম্ভব।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘সরকারের কাজ চিকিৎসক, নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির পাশাপাশি জনগণকে সেবা দেওয়া। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেবা ও একাডেমিক হাসপাতাল আলাদা না হলেও মূল উদ্দেশ্য এক। একাডেমিক হাসপাতালে রোগ নির্ণয়, রোগীকে কাউন্সিল, অস্ত্রোপচার শেখানো হলেও এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের সবকিছু শিখতে হয় না। সব করতে গিয়েই মূলত মূল বিষয় থেকে সরে যায়। সরকার যেটা চিন্তা করছে সেটি বাস্তবায়ন কঠিন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফয়েজ আমার দেশকে বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মানে সেটি কলেজের ল্যাবরেটরি। যেখানে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথোলজি, গাইনিকোলজি, মেডিসিন, সার্জারি পড়ার পাশাপাশি রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক, রোগ অনুযায়ী কি ওষুধ দিতে হবে সব এখানেই শেখেন শিক্ষার্থীরা।’

ডা. এমএ ফয়েজ বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষকদের অন্যতম প্রধান কাজ শিক্ষার্থীদের কত উন্নতভাবে পড়ানো যায়, যা নিশ্চিত করতে পারে পরিবেশ। কিন্তু আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে আদৌ কী পরিবেশ বলতে কিছু আছে? এজন্য সরকারের এ চিন্তা অবশ্যই ইতিবাচক। আমাদের বরাবরই সেবায় চোখ থাকলেও শিক্ষায় শুরু হয়নি। বিদ্যমান অবস্থায় রোগী যেমন কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারি।’