
সব উন্নয়ন প্রকল্পের একই দশা। সমীক্ষা বা যাচাই ছাড়া দেশের সম্পদ ইলিশ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটিও টেনে টেনে বাড়তি মেয়াদে মাত্র ৫৭.৮৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ২ মাসে ৪২ শতাংশের বেশি শেষ করার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে এটি অসম্ভব। ৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রকল্পে সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক থাকলেও এই প্রকল্পে সেটা করা হয়নি। ফলে প্রকল্প অনুমোদনের পরই জটিলতার কবলে পড়ে এর বাস্তবায়ন। নতুন এলাকা প্রকল্পে যুক্ত করাসহ ১৩ কারণে প্রকল্পটি প্রথম দফা সংশোধন করা হয়। দুর্গম এলাকার জন্য ৬০টি ড্রোন কেনা হয়। প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ জানান, প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার জন্য মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। করোনার কারণে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হওয়ায় অগ্রগতি কম।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় ও আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ প্রায় ১১ শতাংশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে ইলিশ। প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত। আর ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৮০ শতাংশ আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী, মোহনা ও সাগর থেকে। ইলিশ মাছের পরিভ্রমণ পথ, প্রজননক্ষেত্র, বিচরণ ও চারণক্ষেত্র (ফিডিং এবং নার্সারি গ্রাউন্ড) দিন দিন পরিবর্তিত ও বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে ইলিশ মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়াও ক্রমাগত বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, কর্মসংস্থানের অভাব, অতি কার্যকরী একতন্তু বিশিষ্ট ফাঁস জাল এবং মাছ আহরণের উন্নত পদ্ধতির প্রবর্তন ও নৌকা যান্ত্রিকীকরণের ফলে সামুদ্রিক জলাশয়ে ইলিশ মাছ আহরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসঙ্গত, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছ
নবায়নযোগ্য সম্পদ এই জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদনের পরিমাণ ও প্রাপ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইলিশের স্থায়িত্বশীল আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের ইলিশ সমৃদ্ধ ২৯টি জেলার ১৩৪টি উপকূলীয় উপজেলায় ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প নেয়া হয়। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রকল্পটি ২৪৬ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন পায়। ২০২৪ সালের জুনে অর্থাৎ ৪ বছরে বাস্তবায়ন করা হবে প্রকল্প। সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প নেয়ায় নানান জটিলতার কারণে প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ২৭৬ কোটি ২৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদে ছয়টি বিভাগে মৎস্য অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তির পর ইলিশের আহরণ (২০১৮-১৯) ৫.৩৩ লক্ষ মেট্রিকটন থেকে ৬.২০ লক্ষ মেট্রিকটন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন এবং অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছিল এর উদ্দেশ্য। দক্ষতা বাড়িয়ে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণকারী ৩১ হাজার ৭০০টি জেলে পরিবারের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। জেলেদের ১১ হাজার বৈধ জাল বিতরণ ও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি।
অগ্রগতি ৪ বছর ১০ মাসে ৫৭.৮৯ শতাংশ : প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ২৭৬.২৯ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের আওতায় মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাস বাকি থাকতে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৪ বছর ১০ মাসে অগ্রগতি ৫৭.৮৯ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ফলে ২ মাসে ৪২.১১ শতাংশ শেষ করা কখনোই সম্ভব নয়।
আইএমইডির পর্যবেক্ষক দোবে ইন্টারন্যাশনালের তথ্যে প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, প্রকল্পটির আওতায় বিভিন্ন ধরনের মোট এক হাজার ২৭৮টি অভিযানের বিপরীতে সম্মিলিত বিশেষ অভিযান পরিচালনা ৫৩৪টি (৪২%), বিশেষ অপারেশন পরিচালনা (জাটকা সংরক্ষণ অভিযান, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ইত্যাদি) ১৩ হাজার ১১২টি (৯৮%) এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ৪ হাজার ৪৪৮টি (৮৯%) সম্পন্ন হয়েছে। সুফলভোগী ৩১ হাজার ৭০০ জন জেলের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬২৮ ব্যাচে ১৫ হাজার ৭০০ জনকে (৫০%) গরু লালন-পালনের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প হতে বিকল্প আয়বর্ধক উপকরণ হিসেবে ৩১ হাজার ৭০০টি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৩ হাজার ৩৫৯টি (৭৩.৬৯%) জেলে পরিবারকে বকনা বাছুর প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজারটি বৈধ জাল বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৯৭৪টি (২৭%) বিতরণ করা হয়েছে। প্রকল্প হতে প্রতিটি অভয়াশ্রমে পাঁচজন করে ছয়টি অভয়াশ্রমে মোট ৩০ জন পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় এক হাজার ৭২টি ও ৬টি অভয়াশ্রম সংলগ্ন ১৫৪টি ইউনিয়নে দুই হাজার ৩০৪টি সভার বিপরীতে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত দুই হাজার ১৯৭টি (৯৫.৩৫%) জনসচেতনতা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পণ্
প্রকল্প পর্যবেক্ষণে দোবে ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড বলছে, প্রকল্প নেয়ার সময় সমীক্ষা করা হয়নি। প্রকল্পটির দুর্বল দিকসমূহ, ইলিশ অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলো দ্রুতগামী জলযান না থাকায় অভিযান/বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা এবং তদারকি ব্যাহত হচ্ছে। প্রকল্পভুক্ত ছয়টি ইলিশ অভয়াশ্রমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সীমানা চিহ্নিতপূর্বক কোনো লাল পতাকা/সাইনবোর্ড স্থাপিত হয়নি। মৎস্য সংরক্ষণ আইনে ক্ষতিকর জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ফ্যাক্টরিপর্যায়ে অবৈধ জালের উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রকল্পভুক্ত জেলেদের মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন বিকল্প কর্মসংস্থান তথা পারিবারিক আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
জেলেদের আবাসিক প্রশিক্ষণের সংস্থান থাকায় তাদের আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; জনসাধারণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঝুঁকির মধ্যে মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ এ নিষিদ্ধ ঘোষিত জালের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ করতে না পারা, জেলে কর্তৃক ইলিশ আহরণে অধিক কার্যক্ষম নৌকা, জাল ও ইঞ্জিন ক্রয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশ ও জাটকা আহরণ চাপ পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহর সাথে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২০২৬ সারের জুনে প্রকল্প শেষ হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের খরচও কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, যে পরিমাণ কাজ বাকি আছে আশা করছি আগামী এক বছরে আমরা শেষ করতে পারব।