
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন । এতে জাতীয় সনদকে বিশেষ মর্যাদা ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার কথা আছে । অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূসের মতামত গ্রহণ এবং কিছু শব্দ ও ভাষাগত সংযোজন- বিয়োজন শেষে দু - এক দিনের মধ্যে সনদের চূড়ান্ত খসড়াটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠাবে কমিশন । জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরেছেন । এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও উপস্থিত ছিলেন ।
জানতে চাইলে আলী রীয়াজ বলেন , কমিশনের কাজের অগ্রগতি , বিশেষত দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া ও সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছে । কবে নাগাদ দলগুলোর কাছে এটি পাঠানো যাবে , দলগুলোর সঙ্গে আবার কবে বসা সম্ভব হবে — এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে । শিগগিরই দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠাবে কমিশন । ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আগামী সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে ।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে , জুলাই সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে , যার মধ্যে প্রথম ভাগে জুলাই সনদের পটভূমি , সংস্কার কমিশন গঠন , জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে বর্ণনা করা আছে । দ্বিতীয় ভাগে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো এবং সর্বশেষ ভাগে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা , যেখানে ৯ টি ধারায় অঙ্গীকারগুলো উল্লেখ আছে । জুলাই সনদের খসড়ার নমুনা সংলাপে অংশগ্রহণকারী ৩০ টি দল ও জোটকে গত ২৮ জুলাই দিয়েছিল কমিশন , যার সর্বশেষ ভাগে সাত দফার অঙ্গীকারনামা ছিল । এই অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় ছিল — যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো আগামী সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে । বিএনপি , এলডিপি , লেবার পার্টি , জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট , ১২ দলীয় জোট ও এনডিএম এতে রাজি ছিল । তবে সেদিনই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায় জামায়াতে ইসলামী , এনসিপি , ইসলামী আন্দোলন , এবি পার্টি , গণঅধিকার পরিষদসহ বেশির ভাগ দল ।
দলগুলো জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির পাশাপাশি ওই সনদের অধীনেই নির্বাচনের দাবি করে । ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানিয়েছে , ২৮ টি দল খসড়া সনদের বিষয়ে তখন মতামত জানায় । ১৮ টি দল নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং সনদের আইনি ভিত্তি চেয়েছে । জামায়াত এ দাবিতে ইতিমধ্যে রাজপথে নেমেছে । কমিশনসংশ্লিষ্ট একজন বলেন , ‘ ওই খসড়া ছিল একটি নমুনা মাত্র । এটি দিয়ে বাস্তবায়নের বিষয়ে দলগুলোর মনোভাব বুঝতে চেয়েছি আমরা । অধিকাংশ দলই সনদের আইনি ভিত্তির কথা বলেছিল । তাই সবার মতের প্রতি সম্মান জানিয়ে চূড়ান্ত খসড়ায় সনদের আইনি ভিত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে । যেসব ধারায় দলগুলো “ নোট অব ডিসেন্ট ” দিয়েছে , তাও উল্লেখ আছে সনদের খসড়ায় । দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে সনদ তৈরি করে দলগুলোর স্বাক্ষর নেওয়া হবে । '
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য ও আপত্তি আছে জুলাই সনদের দ্বিতীয় ভাগে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো উল্লেখ করা আছে , যেগুলো আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা আছে । প্রথম ৬ টি ধারায় রাষ্ট্রভাষা , নাগরিকত্ব ও সংবিধান প্রশ্নে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ আছে । ৭ ও ৮ ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং ৯ নম্বর ধারায় মৌলিক অধিকার নিয়ে ঐকমত্যে আসা বিষয়গুলোর কথা বলা আছে । এ ছাড়া ১০-১৩ ধারায় রাষ্ট্রপতি , ১৪-১৬ ধারায় প্ৰধানমন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা আছে । ১৭- ২০ ধারায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিষয়ে বর্ণনা করা আছে । ২১-২৯ ধারায় আইনসভার বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়গুলো আছে । ৩০-৫০ পর্যন্ত বিচার বিভাগ , ৫১-৫৩ পর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থা , ৫৪-৫৭ ধারায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ , ৫৮- ৬৪ ধারায় জনপ্রশাসন , ৬৫ ধারায় স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি উল্লেখ আছে । ৬৪-৮৪ ধারায় দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ আছে ।
ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি করা জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা আছে । চূড়ান্ত খসড়া সনদে বলা আছে , বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় হবে ‘ বাংলাদেশি ’ । সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের দুই - তৃতীয়াংশের সমর্থনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাসহ কিছু বিষয়ে সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে জুলাই সনদে । তবে সংখ্যানুপাতিকে দ্বিকক্ষের বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের । সংবিধানের মূলনীতির অংশে সাম্য , মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার , গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির কথা উল্লেখ আছে , যাতে আপত্তি আছে সিপিবি , বাসদ , জেএসডি , বাংলাদেশ জাসদ , বাসদ- মার্কসবাদী , গণফোরামসহ কয়েকটি দলের ।
প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হতে পারবেন না বলে সনদে বলা আছে । এতে নোট অব ডিসেন্ট আছে বিএনপিসহ তার সমমনাদের । দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা হলে উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ( পিআর ) ভিত্তি নির্বাচনের কথা উল্লেখ থাকবে জুলাই সনদে । দলগুলোকে নিম্নকক্ষের নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী প্রকাশের সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থিতার পাশাপাশি ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের বাধ্যবাধকতার কথা বলা আছে এতে । বিএনপিসহ সমমনারা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের বিরোধী । সিপিবি , বাসদ , জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও আমজনতার দল বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চকক্ষ চায় না । ঐকমত্য কমিশন সরাসরি আসনে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ তে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল । এতে আপত্তি আছে এনসিপি , সিপিবি , বাসদ , বাংলাদেশ জাসদ , জেএসডি , গণফোরাম , বাসদ- মার্কসবাদী , আমজনতার দলের । অন্যদিকে জামায়াত , ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থী দলগুলো পিআরে নারীদের জন্য ১০০ আসনের দাবি করে । ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোটের সুযোগের কথা আছে । তবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো দুটোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করার পক্ষে । সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং শৃঙ্খলাব্যবস্থা হিসেবে সতর্ক করার পাশাপাশি ‘ বিচারপতি ’ পদবি ব্যবহার না করার বিষয়টিও থাকছে জুলাই সনদে ।