
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সাদা পাথর ও রেলওয়ে বাংকার থেকে পাথর লুটের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তারা নদীপারের জায়গা দখল করে ভাড়া দিতেন লুটের পাথর স্তূপ করে রাখার জন্য। আবার সেই পাথর তারাই চার ভাগের এক ভাগ মূল্যে কিনে নিতেন। পাথর লুটের জন্য বিশেষভাবে তৈরি নৌকা এবং পাথর শ্রমিকদেরও এখানে আনা হয়েছিল তাদের সহায়তায়। মূলত লুটের পাথর কম দামে কেনার নেশায়ই লুটে সহায়তা করেন দুই দলের নেতাকর্মীরা। পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই লুটের পেছনে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক চাপ প্রশাসনকে স্থবির হতে বাধ্য করেছে। বৃহস্পতিবার ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর ঘাট, ধলাই নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পারে পাথরের ডাম্পিং জোনগুলো ঘুরে এবং পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য মেলে।
এদিকে বৃহস্পতিবার পাথর লুটের ঘটনায় জড়িতদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। পাথর উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। এদিন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের এক বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া ১২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করে সাদা পাথরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
জানা যায়, ভোলাগঞ্জের ঘাটের আশপাশেই নদীর তীর দখলে নিয়ে জমি ভাড়া দেওয়া হতো লুটের পাথর স্তূপ করার জন্য। ২০ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২২ ফুট প্রস্থের জমির জন্য শুরুতে ৬ মাসে ২ লাখ টাকা এবং সবশেষ প্রতিদিন ২ হাজার টাকা ভাড়া নিতেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। ধলাই নদীর পূর্বে শতাধিক ও পশ্চিমে দেড় শতাধিক ‘পাথর রাখার স্থানের’ তথ্য পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে এসব স্থান দখলে নেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এসব জমি দখল করেই পাথর লুটের ফন্দি আঁটেন তারা। লুটের জন্য ইঞ্জিনচালিত বিশেষ নৌকা তৈরি করে আনা হয় ভোলাগঞ্জে। এসব নৌকা ও দখলি জমির মালিকরাই সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা থেকে আনেন পাথর শ্রমিক। তিনজন শ্রমিককে একটি নৌকা দেওয়া হয়। পাথর লুটের পর তা বিক্রি শেষে নৌকার মালিক এক ভাগ, বাকি ৩ ভাগ দেওয়া হয় তিন শ্রমিককে। যারা জমি ভাড়া নেন, তারা এসব শ্রমিকের কাছ থেকে চার ভাগের এক ভাগ দামে পাথরগুলো কিনে নেন। স্বাভাবিক সময়ে এক নৌকা পাথরের দাম ৮ হাজার টাকা। সেই পাথর তারা শ্রমিকদের কাছ থেকে কেনেন মাত্র ২ হাজার টাকায়।
স্থানীয়রা আরও জানান, ধলাই নদীর পশ্চিম পারে উপজেলা বিএনপির সদ্য পদ স্থগিত করা সভাপতি শাহাবুদ্দিন ছিলেন লাভের ক্ষেত্রে শীর্ষে। তারপরই ছিলেন উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদুর রহমান দুদু, এছাড়া পূর্ব পারে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেলা যুবদলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমেদ রুহেল, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, সদস্য গিয়াস মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা কালাইরাগের বাসিন্দা দুলাল মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আমিনুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাহাবুদ্দিন।
দিনভর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তরের হাতে আরও যাদের নাম এসেছে তারা হলেন-সদ্য পদ স্থগিত হওয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহাবুদ্দিনের ছেলে এজাজ মাহমুদ, ফুপাতো ভাই শৈবাল শাহরিয়ার সাজন, ভাতিজির জামাই সালাউদ্দিন, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, তার ছেলে রিয়াজ উদ্দিন, জৈন উদ্দিন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদুর ভাই বোরহান, আজিম, উপজেলা যুবদলের সদস্য মানিক মিয়া, আরমান আহমদ, যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম, জাকির, ভোলাগঞ্জ গ্রামের মোজাফর, নুর উদ্দিন, মইন উদ্দিন, সালাউদ্দিন, রাজু মিয়া, রাজু মিয়া, রনি, কালা মিয়া, রোকন মিয়া, লাল মিয়া, আজিজুল, আহাদ মিয়া, বেরাই, দুলাল, তেরা মিয়া, রনি, পাড়ুয়া নোয়াগাঁও গ্রামের সাইফুল, শফিকুল, বাঘারপার গ্রামের আব্দুল মতিন, দক্ষিণ ঢালারপার গ্রামের আব্দুস সালাম, সিদ্দিক মিয়া, মধ্য রাজনগর গ্রামের লায়েক মিয়া, নয়াগাংগেরপার রাজু, আখলু, ইমরান, তৈমুরনগর গ্রামের রাজ্জাক, জব্বার, আহাদ, লায়েক, ঘোড়ামারা এলাকার আশিক। এছাড়া ছাত্রদল নেতা হাফিজুর রহমান হাবিব, মোফাজ্জল হোসেন রোমান, জুবায়ের, হারুনুর রশিদ, আমিন রশিদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হুমায়ুন আহমেদ হুমন, সাব্বির-তারা সবাই পূর্ব পারের জমির দখলদার ও পাথর ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সদ্য পদ হারানো সভাপতি শাহাবুদ্দিন যুগান্তরকে জানান, কিছু জমি তার দখলে ছিল সত্যি; কিন্তু পাথর লুটের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। এমনকি তিনি নাকি লুট ঠেকাতে আন্দোলনও করেছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তাকে সহযোগিতা করেনি বলেই লুট ঠেকাতে পারেননি। এ বিষয়টিকে তিনি প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসাবে আখ্যা দেন। উলটো তিনি বলেন, প্রশাসন ব্যর্থতা ঢাকতে রাজনৈতিক নেতাদের দোষী বানানোর চেষ্টা করছে।
যুবদল নেতাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমেদ জানান, তারা বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছেন, যদি লুটপাটে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমন লুটের ঘটনায় ক্ষুব্ধ পরিবেশবাদীরা। ধরিত্রি রক্ষায় আন্দোলনের (ধরা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, এই পাথর উত্তোলনের দাবিতে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সরকারের সিদ্ধান্তকে যেভাবে চেলেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তাতে কিছুটা নমনীয় হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। সেই সুযোগেই এই ভয়াবহ লুটপাট হয়েছে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, আন্দোলনের নামে প্রশাসনকে জিম্মি করা হয়েছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পাথর উত্তোলনের পক্ষ্যে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিয়ে নেতাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। তারপরই আমরা এমন লুটের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। তাতেই বিষয়টি পরিষ্কার যে প্রশাসনই লুটপাটকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছে।
জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসন সব সময়ই তৎপর ছিল। এখনো আছে। কিন্তু নানা কারণে এসব লুট ঠেকানো যায়নি। ইতোমধ্যে যারা জড়িত ছিল, যারা এই লুটের পাথর নিয়ে নানাভাবে ব্যবসা করেছে, তাদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জড়িতদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট : ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর লুটের ঘটনায় জড়িতদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। জেলা প্রশাসন, বিজিবি, র্যাবসহ ৫ জনকে দুই মাসের মধ্যে এ তালিকা আদালতে হলফনামা আকারে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে লুট হওয়া সব পাথর যেসব স্থানে আছে, সাত দিনের মধ্যে সেখান থেকে এনে আগের জায়গায় ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে আদালতে এ ব্যাপারে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দাখিল করতে স্থানীয় সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সেটা নির্ধারণে সাত দিনের মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। কমিটিতে বুয়েটের একজন অধ্যাপক থাকবেন। ক্ষতি নিরূপণ করে তিন মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে পরিবেশ সচিব ও খনিজসম্পদ সচিবকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও বিবাদীদের ওই এলাকায় দিন-রাতে তদারকির জন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মনিটরিং টিম গঠন করে দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন। বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রুলসহ এসব আদেশ দেন।
১২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার : বুধবার সন্ধ্যা থেকে পাথর উদ্ধারে অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী। ভোলাগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকায় বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ১২ হাজার ঘনফুট পাথর ধলাই নদীর পূর্ব পার থেকে জব্দ করে। পরে তা আবারও সাদা পাথরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কে বুধবার রাত থেকে চেকপোস্ট বসিয়ে ১৩৮ ট্রাক পাথর জব্দ করা হয়েছে।
জাফলংয়ে ২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার : গোয়াইনঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পর্যটন স্পট থেকে চুরি হওয়া পাথর উদ্ধারে উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করেছে। অভিযানে পিয়াইন নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ২ হাজার ঘনফুট লুটের পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা পাথর পুনরায় জিরো পয়েন্টে নৌকা দিয়ে ফেলা হয়েছে।
বিএনপি নেতা গ্রেফতার : কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী পূর্ব ইসলামপুর ইউপির চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি উপজেলা বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক। বৃহস্পতিবার ভোরে পাথর লুটের মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।