
নদীদূষণ, বায়ুদূষণ, প্লাস্টিকদূষণসহ নানা দূষণে দেশের পরিবেশ আজ বিষাক্ত। বিশেষ করে পরিবেশদূষণের ফলে রাজধানী ঢাকা আজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ঢাকার চারপাশে নদীগুলো দখলে ও দূষণে এখন মৃতপ্রায়। বায়ুদূষণে এ নগরী প্রায়ই বিশ্বের দূষিত শহরের শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। আর প্লাস্টিক ও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এ নগরীর জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশদূষণ রোধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিভিন্ন সময়ে নদী, বায়ু এবং অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে, শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য এবং পলিথিন ও প্লাস্টিকদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশ অধিদপ্তরও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা দেখাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অনেকে মনে করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনমনে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। বিশেষ করে পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণে পর সবাই ভেবেছিল এবার রাজধানী ঢাকা সত্যি সত্যি তিলোত্তামা নগরী হিসাবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এখন এই নগরী ময়লা-আবর্জনার এক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বায়ুদূষণ কমেনি, নদীগুলো দূষণমুক্ত ও দখলমুক্ত হয়নি। বরং উল্টো দূষণ আরো বাড়ছে। এছাড়া যে টুকু আগে দখলমুক্ত হয়েছিল সেগুলো এখন পুনরায় দখল হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, এই নদী দখলের পিছনে উপদেষ্টার ঘনিষ্টজনেরা জড়িত রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা শরীফ জামিল বলেন, নদীদূষণ ও পরিবেশদূষণ রোধে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার কাছে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। আগের সরকারগুলো যে রুটিন কাজ করেছে এ সরকারও তাই। বরং এ সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ বলে মনে হয়। কিছু বিষয় যা পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে। যেমন নদীদূষণ। দেশের প্রায় সব নদীই দখল ও দূষণের শিকার। এই দূষণ রোধে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। প্লাস্টিকদূষণ ও পলিথিনমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েও সরকার পিছু হটেছে। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণেও মন্ত্রণালয়ের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এই বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ আরো জোরদার করা প্রয়োজন।
বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঘোষণা করেছিলেন যে, এবার ঢাকাকে তিনি বসবাসের যোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তুলবেন। এ জন্য শুরুতেই তিনি বেশ ঢাকঢোল পিঠিয়ে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নানান স্থানে খাল ও নর্দমা পরিস্কার শুরু করেন। অবশ্য এসব খাল পরিস্কার করতে গিয়ে তিনি যে লাল গালিচায় হেঁটেছেন তা বেশ আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অবশেষে অদৃশ্য কারণে পিছু হটেছেন। এই অদৃশ্য কারণ সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলেন। এর মধ্যে উপদেষ্টার অতি আপনজন জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণও কমেনি। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকার অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। বেড়েছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রভাব। এসব কারণে ঢাকা বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকাতে আরো নি¤œগামী হয়েছে।
ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এর ২০২৫ সালের গেøাবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তালিকায় তিন ধাপ পিছিয়ে ১৭১ তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকার আগে রয়েছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও লিবিয়ার ত্রিপলি। গত জুন প্রকাশিত এই তালিকায় বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় দামেস্ক সর্বনি¤œ ১৭৩তম অবস্থানে রয়েছে। তারপরেই ১৭২তম অবস্থানে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি। ঢাকার অবস্থান ১৭১ তম। এরপর আগের ১৭০ ও ১৬৯তম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তানের করাচি ও আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স। দূষিত বাতাস, ভয়াবহ যানজট, নালা-নর্দমার ময়লা উপচে পড়া, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা আর নগর পরিকল্পনার চরম অভাবে ঢাকার এই অবস্থান।
ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। বর্তমানে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা। বর্তমান সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা অসহনীয় সেই সঙ্গে বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। যেভাবে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় পরিণত হচ্ছে এই শহর, তাতে ভবিষ্যতে এখানে টিকে থাকাটাই অস্বাভাবিক।
ঢাকার পরিবেশের মারাত্মক সমস্যাগুলোর অন্যতম বায়ুদূষণ। শহরে বায়ুদূষণের প্রধান দুটি উপাদান হল শিল্পকারখানা ও যানবাহন। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে।
বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে বেশি মিশছে সিসা। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার যানবাহনগুলো প্রতিদিন ১০০ কেজি সিসা, ১ দশমিক ৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড, ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত করে। এসব উপাদান ক্রমাগত বাতাসের সঙ্গে মিশছে। সেই বাতাস আমাদের নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে য²া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি প্রভৃতি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।
ঢাকা শহরের আরেকটি বড় সমস্যা হলো তীব্র যানজট। এই যানজট রাজধানী শহরের অতি পরিচিত দৃশ্য যা নাগরিক জীবনের জন্য এক ভোগান্তি। গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে রাজধানীতে পরিবহন প্রবেশ করতে না পারায় প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এই ১২ ঘণ্টায় রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনকে যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়।