Image description
♦ লুটের পর ৩৫ হাজার ঘনফুট উদ্ধার আটক ১৩০টি ট্রাক ♦ হাই কোর্ট থেকে সাত দিনের মধ্যে পাথর পুনঃস্থাপনের নির্দেশ ♦ জাফলং পাহারায় যৌথ বাহিনী

‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’- প্রবাদের বাস্তব মিল পাওয়া গেল সাদাপাথর লুট হওয়ার পর প্রশাসনের ভূমিকায়। পাথর সাবাড়ের পর এখন আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। লুট ও পাচার ঠেকাতে শুরু হয়েছে জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযান। এরই মধ্যে এক রাতে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার ঘনফুট পাথর। এর মধ্যে ১২ হাজার ঘনফুট ফেলা হয়েছে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রসহ ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে। পাচারকালে আটক করা হয়েছে পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক। লুটপাট ঠেকাতে সমন্বয় সভায় সাদাপাথর ও জাফলংয়ে দিনরাত যৌথ বাহিনী দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সরানো সাদাপাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পুনঃস্থাপন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। একই সঙ্গে পাথর উত্তোলন ও সরানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাদাপাথর লুটের ঘটনায় গত বুধবার রাতে সিলেট জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউসে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় পাঁচটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তগুলো হলো- জাফলং ইসিএ ও সাদাপাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে চেকপোস্টে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে যৌথ বাহিনী, অবৈধ ক্রাশিং মেশিন বন্ধ ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অভিযান চলবে, পাথর চুরির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার এবং চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। এদিকে সাদাপাথর লুট নিয়ে প্রশাসনের সমন্বয় সভার পরই কোম্পানীগঞ্জে অভিযানে নামে যৌথ বাহিনী। কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর এলাকার পার্শ্ববর্তী ভোলাগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মজুতকৃত প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট সাদাপাথর জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত পাথর নৌকা দিয়ে সাদাপাথর পর্যটন এলাকা ও ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়। লুট হওয়া পাথর নদীতে প্রতিস্থাপনের পর সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। লুণ্ঠিত পাথর নদীতে প্রতিস্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার। তিনি বলেন, বুধবার রাতে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করে ফের পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথরসহ ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অভিযান এখনো অব্যাহত আছে।

চেকপোস্ট বসিয়ে ট্রাক আটক : লুণ্ঠিত সাদাপাথর উদ্ধারে বুধবার গভীর রাত থেকে সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়কে চেকপোস্ট বসায় যৌথ বাহিনী। সিলেট এয়ারপোর্ট রোডের বড়শলা সংলগ্ন ‘সিলেট ক্লাবের’ পাশে এই চেকপোস্ট বসিয়ে রাতেই পাথরবোঝাই বেশ কয়েকটি ট্রাক আটক করা হয়। এ ছাড়া মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে একইভাবে পাথর বোঝাই ট্রাক জব্দ করে যৌথ বাহিনী। সূত্র জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ওই মহাসড়কে পাথরবোঝাই ১৩০টি ট্রাক আটক করা হয়েছে। ট্রাকগুলোতে প্রায় ২৩ হাজার ঘনফুট পাথর রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জব্দকৃত এই পাথরও সাদাপাথর এলাকাসহ ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিস্থাপন করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অফিসার, এডিসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধারে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযান চলছে। এখন পর্যন্ত পাথরবোঝাই শতাধিক ট্রাক জব্দ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।

উচ্চ আদালতে রিট : সাদাপাথর এলাকায় নির্বিচারে পাথর লুটের ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হাই কোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীর একেএম নূরুন নবী গণামাধ্যমকে জানান, রিটে ওই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেয় এবং সেখানে যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয় সেটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সাদাপাথর লুটের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও তার ব্যাখ্যা চেয়েও একটি রুল জারির আবেদন করা হয়। রিটে ঘটনা তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব ছাড়াও এতে বিবাদী করা হয়েছে পরিবেশ সচিব, আইজিপি, সিলেটের জেলা প্রশাসক, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ১০ জনকে।

আদালতের নির্দেশনা : পাথর উত্তোলন ও সরানোয় জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে ৬০ দিনের মধ্যে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উত্তোলন করা ও সরানো সাদাপাথর সিভিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জের ওই স্থলে সাত দিনের মধ্যে পুনঃস্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন।

প্রসঙ্গত, ‘সিলেটের সাদাপাথর গায়েব : প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় নজিরবিহীন লুটপাট’ শিরোনামে গত বুধবার একটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিসহ এ নিয়ে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে চার আইনজীবী গতকাল রিটটি করেন। সাড়ে ১২টার দিকে রিটের ওপর শুনানি শুরু হয়। শুনানি নিয়ে আদালত রুল ও অন্তর্বর্তী আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী সঞ্জয় মণ্ডল। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহা. এরশাদুল বারী খন্দকার। আদেশে হাই কোর্ট ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে সাদাপাথর উত্তোলন ও সরানোয় আর্থিক এবং প্রতিবেশ ও পরিবেশের ক্ষতি নিরূপণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন অধ্যাপককে নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তিন মাসের মধ্যে আদালতে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ সচিব ও খনিজ সম্পদ সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি এলাকা থেকে সাদাপাথর যাতে কেউ উত্তোলন ও সরাতে না পারে, সে জন্য সার্বক্ষণিক (দিনে ও রাতে) তদারকির জন্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মনিটরিং টিম (তদারক দল) গঠন করে দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে কমপ্লায়েন্স (অগ্রগতি প্রতিবেদন) রিপোর্ট দাখিল করতে স্থানীয় প্রশাসন ও বিবাদীদের বলা হয়েছে।

আদেশের বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর উত্তোলন ও অপসারণ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ওই সাদাপাথর এলাকা সংরক্ষণের জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। ওই এলাকাকে পরিবেশ আইনের ৫ ধারা অনুসারে ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ ঘোষণার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং পরিবেশের ক্ষতির সমপরিমাণ অর্থ দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায়ের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সে বিষয়েও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিলেটের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে বলে জানান মনজিল মোরসেদ।

ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার : পাথর লুটের ঘটনায় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল ইসলামপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের পাথর লুটের একটি মামলা ছিল। চেয়ারম্যান আলমগীরকে গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান।

যা বলছে জেলা প্রশাসন : সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর এলাকা গতকাল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ। তিনি সাদাপাথর এলাকা ঘুরে দেখে মুখোমুখি হন গণমাধ্যমের। এ সময় তিনি বলেন, বুধবার রাত থেকে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে রাখা প্রায় ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত পাথর রাতেই ধলাই নদীতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাকে জব্দকৃত পাথরও সাদাপাথরসহ নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিস্থাপন করা হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সাদাপাথর এলাকায় সম্প্রতি যে লুটপাট হয়েছে তা রোধে জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে সেগুলো নদীতে প্রতিস্থাপন করা হবে, তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাদাপাথরের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ভবিষ্যতে এমনটা যাতে কেউ করতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রশাসনের কোনো দায়িত্বহীনতা ছিল কি না এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সরকারি দায়িত্বে থাকা সবাই দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, কিছু অসাধু ব্যক্তি অবৈধভাবে ক্ষতিসাধন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষতির মাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’ সাদাপাথরের কী পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে তা জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি নিরূপণ করবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।