
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কুয়ালালামপুর সফরে অভিবাসন ও বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে মালয়েশিয়া। এছাড়া শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, জ্বালানিসহ অন্যান্য খাতে সহযোগিতা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই সফরের মাধ্যমে। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আগে থেকে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং মালয়েশিয়ার সব মহলে মুহাম্মদ ইউনূসের পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার কারণে এই সফরে দুদেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার মিনিস্টার অব অ্যাটেন্ডডেন্স ছিলেন ওই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো থেকে শুরু করে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত তিন দিন পুরো সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন তিনি। এই সফরে মালয়েশিয়ার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের অভাবে দেখা করা সম্ভব হয়নি।
সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ‘সাধারণভাবে দুই মাস আগে থেকে সফরের প্রস্তুতি গতি পায়। এ সফরে মোট আটটি ইন্সট্রুমেন্ট সই হয়েছে এবং এর মধ্যে দুটি আগে থেকে প্রায় চূড়ান্ত ছিল। গত দুই মাসে আমরা ছয়টি ইন্সট্রুমেন্ট চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছি। কারণ মালয়েশিয়ানরা এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। এমনকি যেদিন প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ায় পৌঁছান, সেদিন সকালেও তারা একটি ইন্সট্রুমেন্ট সই করতে প্রস্তুত বলে জানান।’
মালয়েশিয়ার বন্ধু
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমের মধ্যে আগে থেকে পরিচয় ছিল। শুধু আনোয়ার ইব্রাহীম নন, মালয়েশিয়ায় মুহাম্মদ ইউনূসের অনেক বন্ধু রয়েছেন। এ কারণে আনোয়ার ইব্রাহীম অধ্যাপক ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় ৯টি রাজ্য রয়েছে এবং প্রতিটি রাজ্যের একজন করে রাজা আছেন। এবারের সফরে কুয়ালালামপুরের সবচেয়ে কাছের প্রদেশের যে রাজা, তিনি অধ্যাপক ইউনূসের দুটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে একটি ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের সম্মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দেওয়া নৈশভোজ। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা ছাড়া বাকি অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মালয়েশিয়ান।’
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করলেও তাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মোটা দাগে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে এত বেশি সংখ্যক মালয়েশিয়ান দেখা করতে চেয়েছিলেন যে একটি অনুষ্ঠানে যিনি আমন্ত্রণ পেয়েছেন, অন্য অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই দায়িত্বশীল।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনা
আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর আগে দুপক্ষের মধ্যে ‘রেসট্রিকটেড বৈঠক’ হয়, যেখানে শুধু নীতিনির্ধারকরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে সব দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছিল ভারসাম্যপূর্ণ—যেখানে অভিবাসন, বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার ইস্যু, আসিয়ানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। অভিবাসনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান বা আসিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়টিও বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছে।’
বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী আজিয়াটা বিনিয়োগ করেছিল ২০ বছর আগে। তারপর ওই দেশ থেকে বিনিয়োগের মাত্রা কমেছে। এবারের সফরে মালয়েশিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর সঙ্গে ভালো আলোচনা হয়েছে এবং দুই দেশের মাঝে এ সংক্রান্ত যে দূরত্ব ছিল, সেটি কমিয়ে আনার একটি চেষ্টা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘এখানে বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রায় ১৫০ জন মালয়েশিয়ার বড় ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান নিজ উদ্যোগে আরও অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি আগ্রহী হবে।’
অভিবাসন
মালয়েশিয়ায় মোট বিদেশি শ্রমিকের প্রায় ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি। বর্তমানে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বিদেশিদের জন্য বন্ধ আছে। ১৫টি দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি যায় এবং নতুন করে লোক নেওয়ার বিষয়ে তারা কাজ করছে।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মালয়েশিয়ার নিয়ম সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ ছিল—লোক নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যেন বেশি বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশিদের জন্য মাল্টিপল ভিসার সুবিধা প্রধান উপদেষ্টার সফরের আগেই তারা সম্পন্ন করেছিল। এছাড়া প্রটোকল জটিলতায় আটকে পড়া আট হাজার বাংলাদেশিকে ঢোকার অনুমতির বিষয়টিতেও অনুরোধ করা হয়েছে।’