Image description

রাজধানীসহ দেশজুড়ে ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর যৌথ অভিযানেও লাগাম টানা যাচ্ছে না এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের। সংঘবদ্ধচক্রের বেপরোয়া অপতৎপরতা ও অবৈধ অস্ত্রের মুখে মানুষকে জিম্মি করে মালপত্র লুট করার সময় হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ রাজধানীর কারওয়ান বাজারসংলগ্ন সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রটেকশন বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (বঙ্গভবন নিরাপত্তা) মো. সুমন রেজা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।

এর আগে গত ৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার বিবির বাগিচা এলাকার একটি বাসায় ডাকাতির সময় ইসমাইল খান নামের এক বয়স্ক ব্যক্তিকে  শ্বাসরোধে হত্যা করে ডাকাতদল।

এভাবে দিন দিন দেশে বেড়ে চলেছে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকাসহ ২৫টি স্পটে গত এক বছরে নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে পুলিশের তালিকাভুক্ত ৯ শতাধিক ছিনতাইকারী রয়েছে।

গত বছর ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে সাতজন নিহত হয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে ছিনতাই-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায়  বিব্রত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) শেখ মো. সাজ্জাত আলী থানা পুলিশের উদ্দেশে বলেন, ‘ছিনতাই বেড়ে গেলে মানুষ অনিরাপদ বোধ করে। ছিনতাই প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

’ গত বুধবার রাজারবাগে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ছয় মাসে এক হাজার ৬০০ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার  করেছে ডিএমপি। ডাকাতি ও ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমরা তৎপর রয়েছি।’

সূত্র বলছে, শুধু ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়, সম্প্রতি ডাকাতদলও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, এক বছরে (২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই) সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে মোট দুই হাজার ৪৫৭টি।

সে হিসাবে এই সময়ে মাসে গড়ে ২০৫টি মামলা হয়েছে। এক বছরে মহানগরের মধ্যে সর্বাধিক মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগরে ৪৫২টি এবং রেঞ্জের হিসেবে ঢাকা রেঞ্জে ৫৮০টি।

এর আগের বছর (২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত)  সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে এক হাজার ৬১৯টি। ওই সময়ে মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ১৩৫টি। 

পুলিশ সদর দপ্তরের এই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে পরের বছরে ৮৩৮টি মামলা বেশি হয়েছে। এ সময়ে মাসে ৭০টি মামলা বেশি। 

পুলিশের মামলার হিসাবে দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় চলতি এক বছরে ডাকাতি-দস্যুতার মামলা বেড়েছে ৮৩৮টি। শতাংশের (৫১.৭৬ ) হিসাবে ৫১ শতাংশের বেশি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এক হাজার ৩৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৪২টি, ফেব্রুয়ারিতে ২২৭টি, মার্চে ২৩১টি, এপ্রিলে ১৯৫টি, মে মাসে ২৪৪টি, জুনে ১৯৭টি ও জুলাইয়ে ২২৫টি  মামলা হয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালের আগস্টে ৯৯টি, সেপ্টেম্বরে ১৬২টি, অক্টোবরে ২২৫টি, নভেম্বরে ১৮০টি ও ডিসেম্বরে ২৩০টি মামলা হয়েছিল।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সব সময় ডাকাতি ও ছিনতাই মামলা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না। যেসব ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ যায় বা মামলা হয়, মূলত সেগুলোই নথিবদ্ধ হয়। হয়রানি বা বাড়তি ঝামেলার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী থানায় যান না। আবার থানাগুলো অনেক ক্ষেত্রে ছিনতাই বা চুরির মামলা না নিয়ে টাকা হারানো বা মূল্যবান জিনিসপত্র হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়। তবে পুলিশ বলছে, এখন কেউ যদি মামলা  দিতে চায়, তাতে তাদের কোনো অনিহা নেই।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনো পুলিশের মনোবল ফেরেনি। তবে পুলিশ চেষ্টা করে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে।’

মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে।’

আরো যেসব ছিনতাই ডাকাতির ঘটনা

ছিনতাইয়ের বিষয়ে পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত ৩০ জুন রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে মোরশেদ আলম তানিম নামের এক ব্যক্তি ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এরপর গত ১৭ জুলাই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে চাপাতি দেখিয়ে ছিনতায়ের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর  আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার কদমতলিতে মো. আমিন হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে ছুরি মেরে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়। গত ২৮ জুলাই দিনে-দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ থানার মেট্রোস্টেশনের পাশ্ববর্তী এলাকায় রঞ্জন চন্দ্র সিংহ নামের এক ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পোশাকে একদল ডাকাত অস্ত্রের মুখে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে উঠিয়ে তাঁর কাছ থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার ভর্তি ব্যাগ লুট করে নেয়। ভুক্তভোগী রঞ্জন চন্দ্র সিংহ দাবি করেন, ওই ব্যাগে নগদ চার লাখ টাকা এবং ১১ ভরি স্বর্ণালংকার ছিল। এ ঘটনায় গত ৩১ জুলাই তিনি শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘ছিনতাইকারীকে ধরতে গেলে হাতে থাকা ছুরি দিয়ে ছিনতাইকারী এডিসি সুমন রেজাকে আঘাত করে। এতে এডিসি সুমন রেজার ডান হাতের মধ্যমাংশ কেটে যায়। তখন ছিনতাইকারী দ্রুত পালিয়ে যায়।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত সাড়ে ছয় মাসে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত প্রায় সাত হাজার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে শুধু তেজগাঁও বিভাগ। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর থানা এলাকা থেকেই তিন হাজারের বেশি অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। 

মহাসড়কে ডাকাতি বেড়েছে

সম্প্রতি মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ডাকাতরা যাত্রীদের জানমালের ক্ষতি করছে। সম্প্রতি তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়ে, পাবনার সাঁথিয়ায়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গণডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটেছে।