
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ভারতের জলপাইগুড়ির গজলডোবা নামক স্থানে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা ব্যারেজ থেকে পানি ছাড়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। এতে উজানের ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে নীলফামারীতে প্লাবিত হয়েছে নিচু এলাকা। নদীর পানির গতি স্বাভাবিক রাখতে খুলে রাখা হয়েছে নীলফামারীর ডালিয়ায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি স্লুইস গেট।
আজ বুধবার (১৩ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমা (৫২.১৫) থেকে ৩ সেন্টিমিটার (৫২.১৮) ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে অতিরিক্ত একটানা বৃষ্টিতে তিস্তা নদীসহ নীলফামারীসহ পাশ্ববর্তী জেলার একাধিক নদী ফুলেফেঁপে উঠেছে। গ্রামীণ রাস্তায় পানি জমে গিয়ে চলাচলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। নদীর পানির স্রোত বেড়ে যাওয়ায় চাষের জমি ও ঘরবাড়ি তিরমুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নদীতীরবর্তী বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ভয় ও অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্ট ও পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার নদীর পানি হুহু করে বাড়ছে। ওই দুই পয়েন্টে সতর্কতায় কমলা সংকেত জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর মধ্যে তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা (২৯.৩১) থেকে ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও পাটেশ্বরীতে দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা (৩০.৮৫) থেকে ৩৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অপর দিকে আজ বুধবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে খবর পাওয়া গেছে উজানের ভারতের জলপাইগুড়ির গজলডোবা তিস্তা ব্যারেজ থেকে দফায় দফায় পানি ছাড়া হচ্ছে। এ দিন সকাল আটটায় গজলডোবা তিস্তা ব্যারেজ থেকে ১ হাজার ৫৪৬ কিউসেক ও দুপুরে ১ হাজার ৭২৯.৪০ কিউসেক পানি ছাড়া হয়। ভারতীয় অংশের তিস্তা অববাহিকার সীমান্তবর্তী এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। মেখলিগঞ্জ থেকে বাংলাদেশ কালিগঞ্জ সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তার অসুরতি এলাকায় লাল সতর্কতা, আর সুরতি এলাকায় হলুদ সতর্কতা জারি হয়েছে। সূত্র মতে, গজলডোবা থেকে যে পানি ছাড়া হয়েছে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সময় লাগবে প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। ফলে আজ রাতে তিস্তায় উজানের আরও একটি ধাক্কা ধেয়ে আসছে।
অপর দিকে নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্র মতে ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা অববাহিকার ডালিয়া পয়েন্টে ১৩২ মিলিমিটার অতিভারি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। নীলফামারীর তিস্তা বিধৌত ডিমলা উপজেলা শহরে আবহাওয়া অফিস বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে ১১৯ মিলিমিটার, নীলফামারী শহরে ৯০ মিলিমিটার, তিস্তার কাউনিয়ায় ৩৮ মিলিমিটার, চিলমারীতে ৬৩ মিলিমিটার, বদরগঞ্জে ৫৭ মিলিমিটার, ধরলার পাটেশ্বরীতে ৮৯ মিলিমিটার, পঞ্চগড় শহরে ২০০ মিলিমিটার, দিনাজপুরের কাঞ্চনে ১২৮ মিলিমিটার ও ঠাকুরগাঁও টাঙনে ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে বাপাউবো। যা নিশ্চিত করেন বাপাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম শোভন। একই সূত্র মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা অববাহিকার উজানের ভারতের আলিপুরদুয়ারে ২১০ মিলিমিটার, কোচবিহারে ১০৫ মিলিমিটার ও জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে ভারতীয় বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র অবগত করেছে। সূত্র মতে, এমন টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি যেমন বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে, তেমনি অন্যান্য নদনদীর পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি ভারতের গজলডোবা থেকে তিস্তায় পানি ছাড়ায় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধিতে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়শিঙ্গেশ্বরের ৬টি চর ও মেজারের প্রায় দেড় হাজার, টেপাখড়িবাড়ি এলাকায় ৫ শত পরিবার, খালিশা ছাঁপানী এলাকায় ৩০০ পরিবার, ঝুনাগাছ ছাঁপানী এলাকায় ৫০০ পরিবারসহ প্রায় ৫ হাজার পরিবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, বুধবার (১৩ আগস্ট) সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে সমতলে রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ২২ মিটার, যা বিপৎসীমা (৫২.১৫) থেকে ৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। তবে সকাল ৯টা, বেলা ১২টা ও বিকাল ৩টা পর্যন্ত দুই সেন্টিমিটার পানি কমে বিপৎসীমা থেকে ৪ সেন্টিমিটার (৫২.১৯) ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যা একই পরিমাপে স্থিতিশীল অবস্থায় প্রবাহিত হলেও বিকাল ৬টায় আরও এক সেন্টিমিটার পানি কমে আসে। উজানের ঢলের বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাপাউবো কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সতর্কাবস্থায় থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ খবর পাওয়া গেছে উজানে ভারতের গজলডোবা তিস্তা ব্যারেজ থেকে দুই দফায় ইতোমধ্যে ৩ হাজার ২৭৫ দশমিক ৪০ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। ৪৮টি স্লুইস গেটের প্রতিটি দিয়ে এই পরিমাণ পানি ছাড়া হয়।
তিস্তার পানি বৃদ্ধি ও টানা বৃষ্টিতে নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর এলাকার তিস্তা অববাহিকার চর ও চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখাড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা ছাঁপানী, ঝুনাগাছ ছাঁপানী, গয়াবাড়ী ও জলঢাকার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নিচু এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান বলেন, সবচেয়ে বড় চর গ্রাম ঝাড়শিঙ্গেশ্বরসহ কয়েকটি চর এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। প্রায় দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দি। ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন জানান, তার এলাকার রাস্তাঘাট, ফসলি জমি এখন প্লাবিত। এ ছাড়া তিস্তার বন্যার পানিতে ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি।
উল্লেখ্য, চলতি বছর তিস্তা এ নিয়ে তিন দফায় বিপৎসীমা অতিক্রম করল। গত ২৯ জুলাই রাতে ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, যা টানা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ছিল। এরপর গত ৩ আগস্ট তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দুই দিন পর পানি নেমে যায়।