
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনাভোটের নির্বাচন হওয়ার পথ বন্ধ করতে ‘না’ ভোটের বিধান চালু করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন সভা শেষে গতকাল এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে গতকাল নবম কমিশন সভার মুলতবি বৈঠক হয়। কমিশন সভায় চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন। পরে সন্ধ্যায় ইসির সিদ্ধান্ত তুলে ধরতে সাংবাদিকদের সামনে আসেন কমিশনার আবুল ফজল। বৈঠকে আরপিও ১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করার বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা তিনি তুলে ধরেন। আরপিও সংশোধন প্রস্তাবের অধিকাংশই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই করা হয়েছে উল্লেখ করে এ নির্বাচন কমিশমনার জানান, সরকারের অনুমোদনের জন্য আগামী সপ্তাহে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
চূড়ান্ত আরপিওতে নির্বাচন বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা চূড়ান্ত হলে নির্বাচনে কোনো আসনের ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেখানকার পুরো ভোট বাতিল করতে পারবে ইসি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আরপিওতে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত ও বাতিল নিয়ে যে বিধানগুলো ছিল, যেখানে পুরো কনস্টিটিউয়েন্সির (আসন) নির্বাচন বাতিল বা ফলাফল বাতিলের যে সক্ষমতা, সেটাকে সীমিত করা হয়েছিল। সেটা আবার পুনঃস্থাপন করা হয়েছে, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন অবস্থা বুঝে নির্বাচন স্থগিত করা, এক বা একাধিক বা সব কনস্টিটিউয়েন্সির ফলাফল বাতিল করতে পারবে।’
আরপিওতে ‘না’ ভোটের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে আবুল ফজল বলেন, ‘এই “না” ভোটের বিধানটা হবে যদি কোথাও একজন প্রার্থী হয়, তাহলে তিনি বিনাভোটে নির্বাচিত হবেন না। সার্বিকভাবে “না” ভোট নয়। যদি কোনো কনস্টিটিউয়েন্সিতে (আসন) মাত্র একজন ক্যান্ডিডেট (প্রার্থী) হন, তাকেও নির্বাচনে যেতে হবে। তার বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে “না”। যদি নির্বাচনে “না” পক্ষে বেশি ভোট পড়ে, তবে সেখানে পুনর্নির্বাচন হবে। এতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় রোধ করা সম্ভব হবে।’
জাতীয় নির্বাচনে এক আসনে দুজন প্রার্থী সমান ভোট পেলে আগে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করার বিধান ছিল। কমিশন সেখান থেকে সরে এসেছে। নির্বাচন কমিশনার মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘এক্ষেত্রে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে লটারির বিধান রাখা উচিত বলে কমিশন মনে করে না।’
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আরপিওতে। এসব পরিবর্তনের মধ্যে আরো রয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার বন্ধের আনুষ্ঠানিক বিধান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য রোধের ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, প্রার্থীর ব্যয় নিরীক্ষায় কড়াকড়ি এবং অনলাইনে নারীদের প্রতি সম্মান নিশ্চিতের বিধান।
ইভিএম নিয়ে কমিশনের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামনের নির্বাচনে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে না। ফলে আরপিও থেকে বাতিল করা হয়েছে ইভিএম-সংক্রান্ত সব ধারা ও বিধান। মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু ইভিএমের ব্যবহার হবে না মর্মে আমরা ইতোপূর্বেই কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই এ-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রভিশন বিলুপ্ত করা হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে শাস্তির বিধান আরো স্পষ্ট করা হয়েছে। তদন্ত তিন কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করে গৃহীত ব্যবস্থা কমিশনে জানাতে হবে এবং এ তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথিতে সংরক্ষিত থাকবে।’
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কমিশন অনুমোদিত পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন। গণমাধ্যমকর্মীরা ভোট গণনার সময়ও কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে গণনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরাটা সময় থাকতে হবে। মাঝপথে বের হয়ে যাওয়া যাবে না।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরকে (বিএনসিসি) এ সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কারণ প্রয়োজনে আলাদা আইন ছাড়াই তাদের কাজে লাগানোর সুযোগ ইসির হাতে রয়েছে।
আরপিও ১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায় প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় নিরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আগে ব্যক্তি পর্যায়ে ১০ লাখ ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৫০ লাখ অনুদান নিতে পারত। এখন সেটাকে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ লেনদেন হতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ট্যাক্স রিটার্নে এটা দেখাতে হবে। তাছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে ভোট করতে হলে লড়তে হবে নিজ দলের প্রতীকে। আর নির্বাচনী প্রচারে শুধু ডিজিটাল বিলবোর্ডে আলো বা বিদ্যুতের ব্যবহার অনুমোদিত থাকবে, অন্যথায় আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ।’
নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ১৫ দিন পর পর্যন্ত পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলি কমিশনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কোনো দলের নিবন্ধন আবেদন বাতিল হলে ১৫ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যাসহ জানাবে কমিশন, যাতে আদালতের মাধ্যমে ফের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার প্রবণতা রোধ করা যায়। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ হলে তার নিবন্ধনও স্থগিত বা বাতিলের বিধান আরো সুস্পষ্ট করা হয়েছে। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচিত পদ বাতিল হতে পারে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে। তবে পাঁচ বছর পর তা ইসির এখতিয়ারে থাকবে না।
প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকল ২২ দল
বর্তমানে ১৪৩টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় ছিল ২২ জুন। কোনো আবেদনই প্রথমে পূর্ণাঙ্গ ছিল না। ফলে ১৫ দিন সময় দিয়ে ঘাটতি পূরণের সুযোগ দেয়া হয়। ৮৪টি দল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছে, বাকি ৫৯টি দল কোনো সাড়া দেয়নি। যাচাই শেষে ২২টি দলকে প্রাথমিকভাবে সঠিক বলে বিবেচনা করা হয়েছে, যেগুলো মাঠপর্যায়ে যাচাইয়ে যাবে। বাকি ১২১টি দলের আবেদন বাতিল বিবেচনা করে কারণসহ ফেরত পাঠানো হবে।
নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে ইসি। এক্ষেত্রে আপত্তি জানানোর সময়সীমা শেষ হয়েছে। মোট ৮২টি আপত্তি পাওয়া গেছে। এখন এসব আপত্তির শুনানি হবে।
কমিশন সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, ইসি সচিব আখতার আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।