Image description
 

দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। ব্যাংকিং আইন সংশোধন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান, রেমিট্যান্সের রেকর্ড সংগ্রহ, ডলারসংকট দূর হওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং তারল্যসংকট সমাধানের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপে অর্থনীতিতে স্বস্তি এসেছে।

তথ্যমতে, দেশের দ্রুত কমে আসা রিজার্ভ গত এক বছরে ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এর নেপথ্যে মূল অবদান প্রবাসীদের। তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রিজার্ভ এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ২ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ঘাটতি থেকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৯৮ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি ঘাটতি ছিল ৬৫১ কোটি ডলার। গত জুন শেষে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩২৯ কোটি ডলার। 

 

তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই সম্ভাবনাকে টেকসই করতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি হুন্ডি বন্ধ করে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলেই রেমিট্যান্স নিশ্চিত করতে হবে। এতে আয় আরো বাড়বে এবং ভবিষ্যতে এটি ৫০ বিলিয়ন বা তারও বেশি হতে পারে। রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির এক পরোক্ষ চালিকাশক্তি।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ ছিল। সরকার বদল হওয়ায় প্রকৃত হিসাব প্রকাশ পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরুতে ১০টির বেশি ব্যাংক, ১৫টির মতো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং কিছু বিমা কোম্পানি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। টাকার হাহাকার রোধের স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিতে গত ৩০ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়। এর মাধ্যমে গ্রাহক সঞ্চয়ের কমপক্ষে ২ লাখ এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। আগে কোটি টাকার আমানতধারীও ফেরত পেতেন সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। ব্যাংককে দেওয়ার জন্য টাকা ছাপানো হবে না বলেও দেওয়া অঙ্গীকারটি অবশ্য রাখতে পারেনি সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুবাদে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত বছরের আগস্টে তা ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমে আসার অন্যতম কারণ ডলার দরে স্থিতিশীলতা। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি অর্থ পাঠানোর কারণে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে এখন হুন্ডি প্রবণতা কমেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে এক বছরে রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে কম সুদের কাঙ্খিত ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে রিজার্ভ বেড়ে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রয়েছে। গত কয়েক দিনে ডলারের দর কমছে। আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরো কমার ক্ষেত্রে যা সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।’

ব্যাংক খাত ঢেলে সাজাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডজনখানেক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলমের যথেচ্ছাচারে বিপর্যস্ত দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকটি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। ব্যাংকিং আইন সংশোধন করা হয়েছে। পরিচালকদের মতামত গোপন করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে শত শত খেলাপির বন্ধকি সম্পদ ব্যাপকহারে নিলামে তোলা হচ্ছে। রাজনৈতিক পালাবদলে লুকানো খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় তা হু হু করে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকায়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক হেলাল আহমেদ জনি জনকন্ঠকে বলেন, ‘রপ্তানির পেছনে ইনপুট কস্ট ও সাবসিডি ছাড়াও রয়েছে লজিস্টিকস ও মার্কেটিং ব্যয়। অথচ একজন প্রবাসী শ্রমিক শুধু নিজের শ্রম ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতি মাসে পরিবারকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন, যা সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। রেমিট্যান্সের আরো বড় ইতিবাচক দিক হলো এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। কারণ বেশিরভাগ প্রবাসীর পরিবার থাকে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে এই অর্থ খরচ হয় নির্মাণ, কৃষি ও ছোট ব্যবসায়। ফলে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে।’