
দেশ, জাতি ও ঐক্যের স্বার্থে জুলাই সনদের মৌলিক বিভিন্ন প্রস্তাবে আরও ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আবারও বৈঠকে বসতে পারে দলটি। এর ফলে এরই মধ্যে বিএনপি যেসব সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছু পুনর্মূল্যায়ন করা হতে পারে। গত শনিবার রাতে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে এ বিষয়টি উঠে এসেছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন তারেক রহমান।
বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, সহসভাপতি তানিয়া রব, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, জোটের সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, দলের মুখপাত্র আব্দুল কাদের প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বৈঠকে জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে বিএনপি অত্যন্ত আন্তরিক। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে দলটি। প্রায় অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপি ও অন্য রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঐক্যের স্বার্থে বড় দল হিসেবে তারা এরই মধ্যে অনেক ছাড় দিয়েছে। যার বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার কমিশনের ১৯টি মৌলিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোয় একমত এবং কয়েকটিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে বিএনপি। এমন অবস্থায় তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে জুলাই সনদে যাতে আরও বেশি ঐকমত্য তৈরি হয়, সেজন্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এর সংখ্যা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তখন তারেক রহমান বলেন, এটা নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে তিনি আবারও আলোচনায় বসবেন। যদি আরও কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকে, ঐক্যের স্বার্থে সেটা বিবেচনা করবেন এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ ছাড়া জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেন টেকসই হয় এবং ভবিষ্যতে আদালতে যাতে তা চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে, সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন মঞ্চের নেতারা। এ প্রসঙ্গে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি তুলে ধরেন তারা, যেটি পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে বাতিল করা হয়। তখন তারেক রহমান বলেন, বিএনপি জুলাই সনদ নিয়ে আন্তরিক। তারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া যাতে টেকসই হয়, সে বিষয়টিও তাদের বিবেচনায় রয়েছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আগামীতে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির আরও আলোচনা হবে। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাড়া ঐকমত্য হওয়া অন্য সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো সরকার আইনি প্রক্রিয়ায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে যে কোনো সময় করতে পারে। শুধু সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো নির্বাচিত সংসদ করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, জুলাই সনদে যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমরা সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের সংশোধন-পরিবর্তন-পরিমার্জন এবং নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এবং এসব সংস্কার টেকসইয়ের প্রতি অঙ্গীকার করছি—এ প্রস্তাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। আমরা একমত হয়েছি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণ পন্থার উত্থান ঘটেছে বলে বৈঠকে এক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এটা ঠেকাতে পাল্টা ‘রাজনৈতিক বয়ান’ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। নেতারা বলেন, বাংলাদেশ মধ্যপন্থার দেশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এই দেশটা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সবার। এখানে সবার সমান অধিকার রয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। এখানে উগ্রপন্থার কোনো সুযোগ বা স্থান নেই। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তাই ‘সম্মিলিত জাগরণ’ তৈরির মাধ্যমে এটা মোকাবিলা করতে হবে।
বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, জনগণ মনে করে—আগামী নির্বাচনে বিএনপি অ্যাবসুলিউট মেজরিটি নিয়ে সরকার গঠন করবে। আর নির্বাচনে বিজয়ী হলে যুগপতের মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের অঙ্গীকার রয়েছে বিএনপির। বিএনপির এই অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তারা এ-ও বলেন, একটি রাষ্ট্রে টেকসই গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলেরও প্রয়োজন রয়েছে, যারা ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সরকারকে আরও কার্যকর করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ মনে করে, পুরোনো যে বন্দোবস্তে এতদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়েছিল, সেটা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে মৌলিক পরিবর্তনের জন্য কমপক্ষে আগামী ১৫ বছরের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ক্ষমতার গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে।