
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ঋণচুক্তির সময় ডিপিপিতে ( উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব ) উল্লেখ না থাকা কিছু কাজ পরে প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছে । বাড়তি এসব কাজে খরচ হয়েছে ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ( ডলারের বর্তমান বিনিময়হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকা ) । এই টাকা ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে প্রকল্পটিতে অর্থায়নকারী চীনের এক্সিম ব্যাংক । ফলে ঠিকাদারকে এই অর্থ পরিশোধের দায় চাপল বাংলাদেশ সরকারের ওপর । চীনের এক্সিম ব্যাংক গত ২৪ জুলাই বাড়তি এই অর্থ ঋণ না দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে ( ইআরডি ) জানিয়ে দিয়েছে । প্রকল্পের চূড়ান্ত হিসাবের সময় মূল্য নির্ধারণের দিন ডলারের বিনিময়হার অনুযায়ী টাকার অঙ্ক কিছুটা কমবেশি হতে পারে ।
ইআরডি এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে । অবশ্য ইআরডির এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন , চীনের এক্সিম ব্যাংক এই টাকা ঋণ না দেওয়ায় বরং ভালোই হয়েছে । কারণ, ঋণ নিলে সুদসহ ফেরত দিতে হতো । এখন সরকার নিজেই অর্থায়ন করলে দর-কষাকষি করে কম টাকা পরিশোধের চেষ্টা করবে । তবে এটি সবার জন্যই একটি শিক্ষা । ভবিষ্যতে ঋণচুক্তি করার সময় এসব বিষয় আরও গুরুত্ব পাবে । জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো . ফাহিমুল ইসলাম গত বুধবার বলেন , “অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ( ইআরডি ) থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি আমরা পেয়েছি । তবে আপনি বিস্তারিত জানার জন্য প্রকল্প অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন । ’
তবে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের দপ্তরে জানতে চাইলে আনুষ্ঠানিকভা কথা বলতে কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন । চীনের এক্সিম ব্যাংকের দাবি , পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে যেসব খাতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে, সেগুলো ঋণচুক্তির আওতায় ছিল না । এ খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাঙ্গায় ছোট স্টেশনের পরিবর্তে আইকনিক স্টেশন নির্মাণ , টিটিপাড়া আন্ডারপাস নির্মাণ , এসি কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি, বায়ো টয়লেট সংযোজন , এসি কোচের খুচরা যন্ত্রাংশ কেনা , সিসি ক্যামেরা বসানো , বরিশাল রুটের জন্য ইয়ার্ড লাইন নির্মাণ, সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল ভবন তৃতীয় তলা থেকে উঁচু করা , প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য বাড়ানো , ঢাকা ( কমলাপুর ) থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত দুই লাইনের পরিবর্তে রেলের তিনটি লাইন করা , তুলারামপুর রেলওয়ে সেতু নির্মাণ , ঢাকা - গেন্ডারিয়া রুটে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ এবং শিবচর স্টেশনে এক্সেস রোড নির্মাণ করা । প্রকল্প সূত্র জানায় , পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে বাড়তি কাজের খরচের বিষয়টি ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকল্প দপ্তর থেকে ইআরডিকে জানানো হয় ।
পরে ইআরডি ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি চীনের এক্সিম ব্যাংককে চিঠি দিয়ে ঋণচুক্তির বাইরে কাজের ৭৭ বিলিয়ন ডলার খরচ মঞ্জুর করার অনুরোধ করে । এ নিয়ে পরে একাধিক বৈঠক হয় । সর্বশেষ চলতি বছরের ২ জুলাই ঢাকায় চীনের এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি , ইআরডি এবং প্রকল্প দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয় । ওই বৈঠকে ইআরডি ঋণের এই অর্থ দিতে ব্যাংকটিকে আবার অনুরোধ জানায় । বৈঠকে এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিরা কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি । তাঁরা বলেছিলেন , দেশে ফিরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন । এরপর ২৪ জুলাই এক্সিম ব্যাংক ই - মেইলের মাধ্যমে অতিরিক্ত কাজে খরচ হওয়া ৭৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ না দেওয়ার কথা ইআরডিকে জানায় । ফলে এই অর্থ এখন বাংলাদেশ সরকারকেই ঠিকাদারকে পরিশোধ করতে হবে ।
প্রকল্প সূত্র আরও জানায় , এক্সিম ব্যাংক থেকে অর্থ না পাওয়ায় বিষয়টি সমাধানে ২৪ জুলাই প্রকল্পের প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির ( পিএসসি ) সভা হয় । ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় , যেহেতু চীনের এক্সিম ব্যাংক ওই অর্থ ঋণ দেবে না , তাই প্রকল্পের ডিপিপিতে অর্থায়নের ধরন ( মুড অব ফাইন্যান্স ) পরিবর্তন করতে হবে । এ জন্য ডিপিপির তৃতীয় সংশোধনী করা হবে । পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে মোট নির্মাণ চুক্তির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা । এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক দিয়েছে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা । বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ৩ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা । এদিকে প্রকল্পের ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর । যদিও নির্মাণকাজ লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত । ফলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পের ডিপিপির তৃতীয় সংশোধনী করতে হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র । ২০২৩ সালে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের একাংশ চালু করা হয় । ঢাকা থেকে সরাসরি যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে । তবে এখনো কিছু নির্মাণকাজ বাকি রয়েছে । বিশেষ করে টিটিপাড়া আন্ডারপাসে কার্পেটিং এবং ভাঙ্গা জংশনে গ্লাস , এসি বসানোসহ ফিনিশিংয়ের কাজ শেষ হয়নি । প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন , বাড়তি কাজের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ না দেওয়ায় ঠিকাদারেরা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন । প্রকল্পের জুলাই মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে , কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৯৭.৬০ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ শতাংশ । প্রকল্প সূত্র জানায় , চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণের অর্থছাড় না করায় ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ঠিকাদারের ১০ টি বিলের আরও প্রায় ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে । এই অর্থছাড়ের জন্য এক্সিম ব্যাংককে বারবার তাগাদা দিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ । এ নিয়ে তিন - চারবার ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে ; কিন্তু অর্থছাড় হয়নি । প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন , এখন যেহেতু ব্যাংক বাড়তি কাজের প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকা ঋণ না দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে জানিয়েছে , তাই বাকি অর্থছাড়ে আর বাধা থাকার কথা নয় । এক্সিম ব্যাংক শিগগিরই এ বিলগুলোর টাকা ঠিকাদারকে দেবে বলে আশা করা
হচ্ছে ।
২৭
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত মোট ২৩৬ দশমিক কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে । এর মধ্যে মেইন লাইন ছিল ১৭২ দশমিক ৯৭৫ কিলোমিটার , লুপ লাইন ৬২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার । রেললাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে । প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে জি - টু - জি পদ্ধতিতে । এ প্রকল্পের ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে গ্রুপ । প্রকল্পের নথির তথ্য বলছে , ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৬২৮ দশমিক ৯০ কোটি টাকা । এর মধ্যে নির্মাণ চুক্তির আওতায় ছিল ২৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা । অবশিষ্ট খরচ হয়েছে ভ্যাট ও ট্যাক্স ৮ হাজার কোটি , ভূমি অধিগ্রহণ ৪ হাজার কোটি , পুনর্বাসনে ২০০ কোটি , ইউটিলিটি পরিষেবা স্থানান্তর ৩০০ কোটি , পরামর্শক ব্যয় ১ হাজার ৩৩৩ কোটি , বেতন - ভাতা ও অন্যান্য প্রশাসনিক খরচ ৫০ কোটি টাকা । সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড . শামসুল হক বলেন , দেশে উন্নয়ন প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে । আগে মাঠে নামা হয় , হোঁচট খাওয়ার পর ভুল ধরা পড়ে । বাইরের লোক এনে কাজ করানো হয় । নিজেদের কোনো পরিকল্পনা নেই । এতে ভুলের পর ভুল হয় । বিদেশি দাতা সংস্থারাও সুযোগ নেয় । টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নিজেদের দক্ষতা ও পরিকল্পনাশক্তি গড়ে তুলতে হবে ।