
বরিশালের আমড়া। এটি শুধু একটি ফল নয়, দক্ষিণাঞ্চলের মাটির গন্ধ, চাষিদের শরীরের ঘাম আর নদীপথের হাটবাজারের উচ্ছ্বাসে ভরা এক অনন্য ঐতিহ্য। আষাঢ়ের শেষ প্রান্তে শুরু হয় বরিশালের আমড়ার মৌসুম। ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ আশপাশের এলাকার শত শত বাগানে তখন ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।
চলতি বছর গত ৩০ এপ্রিল বিশ্ব মেধাস্বত্ব দিবসে শিল্প মন্ত্রণালয় বরিশালের আমড়াকে দিয়েছে জিআই স্বীকৃতি। কৃষি বিভাগের মতে, এই সনদ শুধু কাগজে-কলমে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বরিশালের আমড়ার নতুন পরিচয় মিলল।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা, ঝালকাঠির ভীমরুলি, শতদশকাঠি, হিমানন্দকাঠি—যেখানেই চোখ যায়, দেখা মেলে আমড়ার বাহার।
চাষিদের গল্প
ঝালকাঠি সদরের কাপড়কাঠির ওয়ালিউল ইসলামের বাগানে রয়েছে তিন হাজার আমড়াগাছ। গত বছর তাঁর আয় হয়েছিল প্রায় ৬০ লাখ টাকা। তবে চলতি বছর উৎপাদনে খরার প্রভাব পড়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। তাপমাত্রা ছিল অস্বাভাবিক। ফলে ফুল ঝরে গেছে। ফল হয়েছে ছোট। তবে গত বছরের তুলনায় এবার দাম বেশ ভালো পাচ্ছেন। এ কারণে উৎপাদন কম হলেও লাভের অঙ্কে এগিয়ে আছেন তিনি। কুড়িয়ানা বাজারের পাইকার বরুণ মণ্ডল জানালেন, প্রতি মৌসুমে অন্তত ২০ জন পাইকার প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার মণ আমড়া ঢাকায় পাঠান। কিন্তু এবার ফলন কমেছে, দামেও ভাটার টান। গত বছর মৌসুমের শুরুতে মণপ্রতি দাম ছিল ৭০০ টাকা, শেষ দিকে তা গিয়ে ঠেকেছিল তিন হাজারে। এবার শুরুতে মণপ্রতি দাম এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা হলেও এখন নেমে এসেছে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায়।
আমড়ার চাষ : বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় কমবেশি আমড়ার চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এক হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমিতে বছরে গড়ে উৎপাদিত হয় ২৪ হাজার ৬৮৪ মেট্রিক টন আমড়া। এর মধ্যে শীর্ষে পিরোজপুর। সেখানে আট হাজার ৬৭৭ মেট্রিক টন, ঝালকাঠিতে চার হাজার ৫৭৮ মেট্রিক টন আর বরিশালে তিন হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন আমড়া উৎপাদন হয়। জমির পরিমাণে এগিয়ে ঝালকাঠি। সেখানে ৬০২ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ হচ্ছে।
ঝালকাঠি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলী আহমেদ বলেন, চলতি বছর খরার কারণে ফলন কিছুটা কমেছে। কারণ এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বৃষ্টি হয়নি। এর ওপর অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ফুল ঝরে গেছে। ফলনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উপজেলায় প্রায় ২৭০ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ হয়। চাষির সংখ্যা এক হাজার ৬২৫। এই তালিকার বাইরেও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে আমড়া চাষ করছেন।
ঐতিহ্য স্বাদে অনন্য : বরিশালের আমড়া শুধু বাজারদরের হিসাবে নয়, এটি এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর জীবন, নদীভিত্তিক বাণিজ্য আর স্থানীয় সংস্কৃতিরও অংশ। স্বাদে টক-মিষ্টি, আচার থেকে ঝোল—যেখানে যেভাবে পড়ুক, আলাদা করে চেনা যায় বরিশালের আমড়া। জিআই স্বীকৃতি মেলায় রপ্তানি বাজার খুলে গেলে চাষিরা আরো লাভবান হবেন।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বরিশালের আমড়ার পরিচিতি ও চাহিদা বাড়বে। এই স্বীকৃতি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। ফলটি স্বাদে-গুণে-মানে অনন্য—বাজারে এই আস্থা তৈরি হবে। এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমড়া রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে।