
আলোচিত দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনস ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বছরের পর বছর। গত ১৬ বছর তারা লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম করেছে। টেন্ডার জালিয়াতি করেছে, ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ করছে। নিম্নমানের কাজ করে বিল তুলে নিয়েছে। কাজ না করেও বিল তুলে নিয়েছে। আর এসব অপকর্ম এবং অনিয়ম ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ তাদের প্রশ্ন করেনি। তাদের কোনো বিচার হয়নি। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও তাদের তদন্ত করতে গিয়ে থমকে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব দুর্নীতি থামাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজম। মির্জা আজমের কারণেই তমা-ম্যাক্স অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়ন বাজেটের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেত পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাত। এর মধ্যে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে রেলের সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ। মূলত আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এ দুই প্রতিষ্ঠান রেলের সব মেগা কাজ করেছে। আর এসব কাজের ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা। এসব কাজে দফায় দফায় প্রাক্কলিত মূল্য বাড়ানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজবাড়ী-টুঙ্গিপাড়া রেলপথ প্রকল্প, পাবনা-ঈশ্বরদী-ঢালাচর রেলপথ, চট্টগ্রাম দোহাজারি থেকে রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ। আখাউড়া-লাকসাম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ দফায় দফায় বাড়িয়ে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ লোপাট করেছে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা। অথচ এসবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় পর্যায়ে যেসব তদন্ত হয়েছিল তার কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। বরং যেসব প্রকল্প পরিচালক তমা-ম্যাক্সের নজিরবিহীন লুটপাটের প্রতিবাদ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। তাদের বদলি করা হয়েছে। তমা এবং ম্যাক্সের বিরুদ্ধে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আসে ২০১৮ সালে। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান টিম তমা-ম্যাক্সের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল রেলপথ নির্মাণকাজে টেন্ডার ছিনতাই ও চীনা কোম্পানি লিমিটেড কর্মকর্তাদের অপহরণের তথ্য-প্রমাণও পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ তদন্ত আটকে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন প্রভাবশালী কমিশনার (সদস্য) ছিল মির্জা আজমের আত্মীয়। তদন্তের একপর্যায়ে মির্জা আজম দৃশ্যপটে আসেন। তমা-ম্যাক্সকে নিয়ে দুদকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন সব তদন্ত ধামাচাপা দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি আবার তমা-ম্যাক্সের দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছিল। গঠন করা হয়েছিল তিন সদস্যের কমিটি। এ কমিটিও তমা-ম্যাক্সের পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে টাকা পাচার করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের সন্ধান পায়, কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে সামনে আসেন মির্জা আজম। মির্জা আজমের হস্তক্ষেপের কারণে শেষ পর্যন্ত তমা-ম্যাক্স গ্রুপের দুর্নীতি আবারও ধামাচাপা দেওয়া হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সূত্রগুলো বলছে, দুদকের ভিতরে-বাইরে প্রভাবশালী মহলের তদবিরে এসব অনুসন্ধান শেষ পর্যন্ত এগোতে পারেনি। সূত্র বলছে, তমা-ম্যাক্সের যোগসাজশে বাংলাদেশে রেলওয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা রেলের সব মেগা প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতেন। বড় বড় প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের পরপরই শুরু হয় তাদের অশুভ তৎপরতা। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্র কেনে, তাদের সবাইকে চাপ দিয়ে সিন্ডিকেটের ছায়াতলে নেওয়া হয়। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে ক্যাডার বাহিনী তাকে জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে। উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন টেন্ডারের প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ দেওয়া হতো মির্জা আজমকে। মির্জা আজম সেই অর্থের একটি অংশ ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের ক্যাডারদের পুষতেন। যেহেতু মির্জা আজম আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং একসময় তিনি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এ জন্য সম্রাটবাহিনীসহ যুবলীগের সন্ত্রাসী গ্রুপটি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। যখনই কোনো টেন্ডার হতো, তখনই মির্জা আজমের নির্দেশে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এ টেন্ডার কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। শুধু তমা এবং ম্যাক্সের পছন্দের প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কাউকে টেন্ডার জমা দিতে দেওয়া হতো না। টেন্ডার জমা দেওয়ার এ প্রক্রিয়া ছাড়াও আরও বহু বহুমাত্রিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল এ দুটি প্রতিষ্ঠান। যখনই একটি টেন্ডার তৈরি করা হতো, তখন তমা-ম্যাক্স মির্জা আজমের সহায়তায় টেন্ডার ডকুমেন্ট পরিবর্তন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এ টেন্ডার ডকুমেন্ট তাদের পছন্দমতো পরিবর্তন না হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই টেন্ডার আলোর মুখ দেখত না। তারপরও যদি কোনো বিদেশি কোম্পানি বা ব্যবসায়ী টেন্ডার জমা দিতে যেত, তাহলে তাদের টেন্ডার ছিনতাই করা হতো। এ রকম টেন্ডার ছিনতাইয়ের ঘটনা রেলে ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সবাই জানতেন মির্জা আজমের ক্যাডাররা টেন্ডার জমা দেওয়ার দিন উপস্থিত হবেন এবং তাদের টেন্ডার জমা দিতে দেবেন, যারা তমা এবং ম্যাক্সের নিয়ন্ত্রণাধীন।
২০০৮ সালে তমা-ম্যাক্সের দুর্নীতি নিয়ে গঠিত দুদকের তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান করে দেখে যে, তমা-ম্যাক্স সিন্ডিকেট ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের কাজের টেন্ডার ছিনতাই করে এবং চীনা কোম্পানি চায়না লিমিটেড কর্মকর্তাকে অপহরণ করে। এ অভিযোগে ওই কোম্পানি একটি মামলা দায়ের করলেও পরে থানায় মামলা নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেনি। থানার কর্মকর্তারা এটি মির্জা আজমের মামলা হিসেবে ধামাচামা দেয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণে কয়েকটি দেশি-বিদেশি কোম্পানি দরপত্র ক্রয় করে। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে তাদের সবাইকে নিয়ে তমা-ম্যাক্স সিন্ডিকেট গঠন করে। দরপত্র কেনার সব দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটে শামিল হয়। একমাত্র চায়না লিমিটেড সম্মত না হয়ে তারা আলাদাভাবে টেন্ডার জমা দেয়। চাইনিজ ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এ অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, এ টেন্ডার জমা দেওয়ার দিন মির্জা আজম নিজেই রেলভবনে উপস্থিত ছিলেন। তার নিয়ন্ত্রণে এবং নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটে। রেল ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে উদ্ধার করা হয় এবং টেন্ডার জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এ নিয়ে রেলপথ অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি করলেও সেই তদন্ত কমিটি কোনো কাজ করেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে অনুসন্ধান করলেও এ অনুসন্ধানের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো মামলাও করতে পারেনি। অনুসন্ধান শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়।
লক্ষণীয় ব্যাপার যে, দুর্নীতির তমা এবং ম্যাক্স সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করেনি। ধীরগতিতে কাজ করে তারা মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও বাড়িয়ে নিয়েছে। ফলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা গেছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ যৌথভাবে করেছে তমা এবং ম্যাক্স। ২০১০ সালে শুরু হলে এ কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেললাইনের কাজ ২০১৪ সালে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। সময় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে। গোপালগঞ্জ থেকে খুলনা পর্যন্ত রেললাইন হচ্ছে। সেই কাজও পেয়েছে তমা এবং ম্যাক্স। তমা এবং ম্যাক্স সারা দেশে রেলওয়ের যে কাজ করেছে, তার সব কাজই এ রকম অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা রয়েছে।
দুদকের সাম্প্রতিক সময় অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে যে, গত এক যুগের ব্যবধানে শুধু রেল না, সড়ক ও জনপথ, বিআইডব্লিউটিএ, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর, ক্রীড়া পরিষদ, সিভিল এভিয়েশনসহ বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছে তমা এবং ম্যাক্স গ্রুপ। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক নির্মাণে তমা কন্সট্রাকশনের সঙ্গে সরকারের চুক্তি মূল্য ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা। সেটা বেড়ে ৪২০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি মূল্যের চেয়ে সরকারের ৭৬ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে। ২০১২ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়ে ২০১৫ সালের শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে।
খাদ্য অধিদপ্তরের অধীনে মোংলা-সাইলো নির্মাণকাজ পায় তমা কনস্ট্রাকশন। এ প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করে তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। সেই সঙ্গে খরচও বাড়ে ৫৪ কোটি টাকা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর কমপ্লেক্স নির্মাণে তমার চুক্তি ছিল ১২৪ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্পের খরচ হয় ১৪১ কোটি টাকা। ১৭ কোটি টাকা বেশি খরচে দুই বছরের এ প্রকল্প ছয় বছরে শেষ হয়।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ, জামালপুর প্রকল্পের আওতায় ২৭টি প্যাকেজের মধ্যে তমা কনস্ট্রাকশন একাই পায় ৮টি প্যাকেজের কাজ। এ প্রকল্প ২০১৬ সালে শুরু হয়, ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা কাজ শেষ করে ২০২১ সালে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭১৭ কোটি টাকা।
পরে তা ২৩৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৯৫০ কোটি টাকা করা হয়। এসব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং ব্যয় বৃদ্ধির কাজে সরাসরি তদারকি করতেন মির্জা আজম। যখনই এ নিয়ে কোনো রকম অনিয়ম হতো, তখন সেসব অনিয়মকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মির্জা আজম কাজ করতেন। মূলত তমা এবং ম্যাক্সের পাহারাদার হিসেবে মির্জা আজম কাজ করতেন। বিনিময়ে মির্জা আজম তৈরি করেছেন সম্পদের পাহাড়। এভাবেই বছরের পর বছর এ দুটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের সব দুর্নীতি, অনিয়মকে প্রশ্রয় দিত তৎকালীন সরকার।