Image description

 গত বছরের সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী একটি গ্রুপের সঙ্গে বিশেষ এক জায়গায় বৈঠক এবং চুক্তি হয় সৈয়দ নুরুল বাসিরের। চুক্তিটি হয় লিখিত। চুক্তি অনুযায়ী সৈয়দ নুরুল বাসিরের পদায়ন হবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে। বিনিময়ে নুরুল বাসির পর্যায়ক্রমে ৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করবেন তাদের। চুক্তি স্বাক্ষরের মুহূর্ত নুরুল বাসিরের ছবিসহ চুক্তিপত্রের কপি ভিডিও করে রাখে ওই প্রভাবশালী গ্রুপটি। সেই চুক্তিতে নুরুল বাসিরকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করার এবং পরবর্তীতে এই পদ থেকে সরাসরি সচিব করারও কথা ছিল। এই জুন-জুলাইয়েই তাঁর সচিব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন তিনি ওএসডি হলেন। ৩০ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে ওএসডি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ রফিকুল হকের স্বাক্ষরে উক্ত প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়েছে। সচিব হওয়ার পরিবর্তে ওএসডি- এমন করুণ পরিণতির জন্য অবশ্য সৈয়দ নুরুল বাসির অন্য কাউকে দায়ী করতে পারছেন না। নিজের লাগামহীন দুর্নীতি-অপকর্মই এরজন্য দায়ী, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।  


গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। বরাবরই প্রতিষ্ঠানটি অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য বহুল আলোচিত। আওয়ামী আমলে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে আওয়ামী আমলের সেইসব দুর্নীতিকেও হার মানিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান সৈয়দ নুরুল বাসিরের সময়টা। তিনি এ প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র এক বছরের কম সময় হলো। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন। সেই হিসেবে মাত্র দশ মাস প্রায়। তবে এই দশ মাস সময়ে তিনি এতটা বেপরোয়া ছিলেন যে অতীতের সকল রেকর্ডকে হার মানিয়েছেন। অবশেষে পার পেলেন না, ওএসডি হলেন। আর এর মধ্য দিয়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে সৈয়দ নুরুল বাসিরের বেপরোয়া দুর্নীতি ও ত্রাসের রাজত্বের অবসান হলো, বলছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

 
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে থেকে এই দশ মাস সময়ে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নীতিমালা সরাসরি লঙ্ঘন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পাওনায়ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে ছাড় দিয়েছেন সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। দেখা গেছে, জাগৃক’র বোর্ড মিটিংয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো সদস্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটিও তিনি গ্রাহ্য করেননি। এমনকি বোর্ড মিটিংয়ের রেজুলেশনেও তা উল্লেখ করতে দেননি। ওই সদস্য সভায় উপস্থিত থাকার পরও তাকে অনুপস্থিত দেখিয়ে সভার কার্যবিবরণী অনুগতদের দিয়ে নিজেরা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজপত্রে দখলদারদের নামে জমির বরাদ্দ অনুমোদন করেছেন ব্যাপকভাবে। জাল-জালিয়াতির এসব কাগজপত্র জায়েজ করার ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে। এ রকমের প্রতিটি কেস-এ বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নীতিমালা অনুযায়ী বাণিজ্যিক প্লট নিলামে দেয়ার কথা। তা না করে নুরুল বাসির মোটা অংকের টাকা নিয়ে অবৈধভাবে কনভারশনের ব্যবস্থা করেছেন। বাণিজ্যিক প্লট নিলামে দেয়া হলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিপুল অংকের অর্থ আয় হতো। নীতিমালা বহির্ভূতভাবে কনভারশনের সুযোগ দেয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধীন রাজধানীর মিরপুরের পুরো এলাকাটিই। এখানে প্লট জাল-জালিয়াতি, অবৈধ দখলদার অসংখ্য রয়েছে। এখানকার প্লট পরিবর্তন, হস্তান্তর প্রভৃতি অত্যন্ত জটিল ধরনের। আর তাই প্রতিটি নথি বোর্ড সভায় উপস্থাপনের আগে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয়। কিন্তু নুরুল বাসিরের আমলে অনেক নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বোর্ড সভায় উপস্থাপন এমনকি অনুমোদনও করে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান নুরুল বাসির কোনো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই নথি বোর্ড সভায় উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও তাই করেছেন। এভাবে ভুয়া কাগজপত্রের অনেক নথিই অনুমোদন হয়ে গেছে বোর্ডে। পরবর্তীতে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ায় নথিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগেই এ ধরনের প্রতিটি নখির বিপরীতে জালিয়াতচক্রের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নুরুল বাসির। আর তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানোর মতো ধৈর্য ছিল না তার। 


সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি প্লট দুর্নীতি হয়েছে চলতি বছরের শুরুতে। এ সময় সংস্থাটির এক সঙ্গে দু’জন বোর্ড সদস্য চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছেন- সদস্য, পরিকল্পনা এবং সদস্য, প্রকৌশল। এরা দু’জনই প্রকৌশলী থেকে এসেছেন। সৈয়দ নুরুল বাসিরের লাগামহীন দুর্নীতিতে এরা কিছুটা হলেও বাধার সৃষ্টি করছিলেন। দুজনই যেহেতু ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ আয়ের ওই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছেন চেয়ারম্যান। সদস্য, প্রশাসন এবং সদস্য, ভূমি- কে সঙ্গে নিয়ে লাগামহীন দুর্নীতি-অপকর্মে নেমে পড়েন তিনি। ঘন ঘন বোর্ড সভা ডাকেন। প্রতিটি বোর্ড সভায় অসংখ্য জাল নথির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় এ সময়। অতীতে দেখা গেছে, বোর্ড সভায় প্লট পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ টি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথমদিকের প্রতিটি বোর্ড সভায় এ ধরনের এক সঙ্গে অনেকগুলো নথি অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়েছে। সদস্য প্রকৌশল এবং পরিকল্পনা- এই দুটি পদে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার আগে এমনকি নিয়োগের পরেও এটা চলেছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য পদে তখন নিয়োগ পান প্রকৌশলী খাইরুল ইসলাম। তাঁকে একসঙ্গে দুটি পদের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেখা গেছে, বোর্ড সভায় তাঁর নোট অব ডিসেন্টকেও পাত্তা দেয়া হয়নি। অবাক ব্যাপার হলো, নোট অব ডিসেন্ট কার্যবিবরণীতেও তোলা হয়নি। এ নিয়ে চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নুরুল বাসিরের সঙ্গে সদস্য খাইরুল ইসলামের কথা কাটাকাটি হয়। যে কারণে তিনি সভায় উপস্থিত থাকলেও কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করতে রাজি হননি। চেয়ারম্যান নুরুল বাসির অবৈধ অর্থ আয়ে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, খাইরুল ইসলামকে অনুপস্থিত দেখিয়ে তাঁর স্বাক্ষর ছাড়াই সভার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন।


শুধু এসবই নয়, আরো অনেক রকমের অনিয়ম-অপকর্ম করেছেন তিনি। তারমধ্যে বদলি বাণিজ্য বহুল আলোচিত। এই দশ মাসে নুরুল বাসির এতটা বদলি বাণিজ্য করেছেন যে, অতীতের দীর্ঘকালের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেসব বদলি-পদায়নে অতীতে সর্বোচ্চ ২/৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হতো, নুরুল বাসির সেগুলোর প্রতিটি থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। বলা যায়, এই দশ মাসে তিনি সংস্থাটিতে অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। আর এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের অর্থ। 


সূত্রমতে, সৈয়দ নুরুল বাসিরের এসব বেপরোয়া অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকেও ইতিপূর্বে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মন্ত্রণালয়ের সতর্কতাকে মোটেই পাত্তা দেননি। আর অবশেষে এখন তাকে ওএসডি হতে হলো।
শীর্ষনিউজ