Image description

দলীয় আনুকূল্যনির্ভর সংরক্ষিত আসনব্যবস্থায় নারী সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী এলাকা নেই। ফলে ভোটারদের সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের কোনো সংযোগ ঘটে না। এ রকম পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত আসনগুলোর সদস্যদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরাসরি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন নারী অধিকারকর্মীরা।

গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তাতে নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন করার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। কয়েকটি দল নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপত্তি তুলেছে।

সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পৃথক দুটি প্রস্তাব ছিল। দুই কমিশনই সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করা এবং সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, নির্ধারিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নারী সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিল না। নারীর কথা, নারীর দাবির কোনো প্রতিফলন ঘটেনি আলোচনায়। তাঁরা আমাদের শুধু হতাশই করেননি, আমরা একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী

অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ১০০টি সংরক্ষিত নারী আসনে ‘ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে’ সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা হবে ৪০০টি। এর মধ্যে ১০০টি সংরক্ষিত থাকবে নারীদের জন্য। এ পদ্ধতি চালু হলে প্রথমবার দ্বৈবচয়ন বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ঠিক করা হবে, কোন ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ওই ১০০টি ছাড়া বাকি ৩০০ আসন থেকে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। এভাবে সংরক্ষিত নারী আসন ঘুরতে থাকবে।

তবে নারী আসনের নির্বাচন নিয়ে দলগুলো একমত না হওয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নতুন আরেকটি প্রস্তাব দেয়, সেটি হলো জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব দল ন্যূনতম ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, সেসব দল তাদের মোট প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থিতা নিশ্চিত করবে। এ জন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। তবে এই প্রস্তাবেও একমত হয়নি রাজনৈতিক দলগুলো।

পরে ঐকমত্য কমিশন সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সেখানে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল। এ বিষয়েও দলগুলো একমত হয়নি। এর পরে ঐকমত্য কমিশন ৫০টি আসন বহাল রাখা এবং ৩০০ সাধারণ আসনের মধ্যে ৫-৭ শতাংশ আসনে দলগুলো নারী প্রার্থী দেবে, এমন প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়েও মতৈক্য হয়নি।

‘নারীদের কথা শুনতে হবে’

রাজনৈতিক দলগুলো নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে একমত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার বিষয়ে প্রায় সব দল একমত হয়েছে। যদিও দু-একটি দলের দ্বিমত রয়েছে। কিছু দল সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ১০০ আসনে উন্নীত করার পক্ষে, আবার কিছু দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের পক্ষে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখা হবে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে বিদ্যমান ৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫ শতাংশ নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানাবে কমিশন। আগামী নির্বাচনের পরের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো ন্যূনতম ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। এটিও সংবিধানে যুক্ত হবে। ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত থাকবে। এটিও সংবিধানে যুক্ত হবে। সংরক্ষিত নারী আসন ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে কোনো নারী প্রতিনিধি ছিল না। নারীর কথা, নারীর দাবির কোনো প্রতিফলন ঘটেনি আলোচনায়। তাঁরা আমাদের শুধু হতাশই করেননি, আমরা একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ।’

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নারী আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন আয়োজন করার সুপারিশ করেছিল। সেসব সুপারিশও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের আলোচনায় অর্ন্তভুক্ত করেনি। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫১ শতাংশ নারী। নারীদের কথা শুনতে হবে।

সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব

সূত্র: নির্বাচন কমিশন, খান ফাউন্ডেশন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো
সূত্র: নির্বাচন কমিশন, খান ফাউন্ডেশন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলো

নির্বাচন কমিশন, খান ফাউন্ডেশনের ‘‘এমপাওয়ারিং উইমেন থ্রু রির্জাভড সিট ইন পার্লামেন্ট: ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স?’ (সংসদে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ণ: লড়াই নাকি পালানোর প্রবণতা?’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন নিউজ লেটার ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৭৩-১৯৭৫ মেয়াদের প্রথম জাতীয় সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিরাই ছিলেন সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭৯-১৯৮২ মেয়াদে দ্বিতীয় সংসদে ২ জন নির্বাচিত ও ৩০টি নারী আসন মিলিয়ে মোট ৩২ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৯০ মেয়াদে চতুর্থ সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না। ৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯১-১৯৯৫ মেয়াদে পঞ্চম সংসদে ৫ জন নির্বাচিত সহ ৩৫ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির এক তরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। ৩০টি সংরক্ষিত আসন ছিল। ওই নির্বাচনটি বাতিল হয়ে ওই বছরের জুন মাসে (১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে) ৭ম সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সরাসরি নির্বাচিত ৮ নারীসহ মোট নারী প্রতিনিধি ছিলেন ৩৮ জন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭টি আসনে সরাসরি ও ৪৫টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট ৫২ জন নারী সংসদ সদস্য হন। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদের নবম জাতীয় সংসদে ২১ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। তবে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের মমতাজ ইকবাল মারা গেলে ওই আসনের উপ নির্বাচনে পুরুষ নির্বাচিত হন। ওই মেয়াদে নারী আসন বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়। মোট নারী সংসদ সদস্য হন ৭০ জন। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এর দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন ছিল একতরফা ও বির্তকিত। দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৮ জন সরাসরি সহ মোট নারী সংসদ সদস্য ছিলেন ৬৮ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৭৩ জন ও ২০২৪ সালে ১৯ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৬৯ জন নারী প্রতিনিধি ছিলেন।

দলগুলোর মনোভাব

নারী আসন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করতে হবে এবং আগের মতো করে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে এসব আসন বিতরণ করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, তাঁরা পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদীয় আসন ৪০০টি এবং এর মধ্যে ১০০টি নারী আসনের বিষয়ে একমত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিরা ১০০ নারী আসনে সারসরি নির্বাচনের পক্ষে। তবে পরে তাঁরা নারী আসনের বিষয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, প্রতিটি দল ১০-১৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। তাতে ৩৫০-৪০০ নারী প্রার্থী পাওয়া যাবে। যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হবেন, তাঁরা সংসদ সদস্য হবেন। আর যেসব নারী প্রার্থী পরাজিত হবেন, তাঁদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ১০০ জন হবেন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।

অন্যদিকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পরে জমা হওয়ায় তাদের সুপারিশ কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স বা কাজের পরিধিতে অর্ন্তভুক্ত করা যায়নি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ফলে দলগুলোর সঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আবার সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা এবং এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেও বিভিন্ন দলের নেতারা মনে করেন।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।

সামান্তা শারমিন বলেন, প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানির মাধ্যমে, দুর্নীতি করে, প্রচুর অর্থ খরচ করে নির্বাচনে জিতে আসেন অনেকে। আরেকটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক নারীকে সংরক্ষিত আসনে জায়গা দেওয়া হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।

‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে সীমাবদ্ধ

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনগুলোর নাম ‘সংরক্ষিত মহিলা আসন’। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। সংরক্ষিত আসনের সুবিধা প্রথমে ১০ বছরের জন্য রাখা হয়েছিল। পরে ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৩০। একই সঙ্গে ১০ বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। ১৯৮৭ সালে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না।

এরপর ১৯৯০ সালে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০০১ সালে অষ্টম সংসদের শুরুতে সংরক্ষিত আসন ছিল না। পরে এই সংসদেই সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর (২০০৪ সালে) মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়। ওই সময় সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। সংসদে একটি রাজনৈতিক দলের কতজন প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই অনুপাতে ওই সংরক্ষিত আসনের কয়টি দল পাবে, তা নির্ধারিত হয়। দলগুলোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে নিজ নিজ দলের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের নির্বাচিত করেন। নবম সংসদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়।

এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।
রুমিন ফারহানা, সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপি

আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতোই মাসিক বেতন–ভাতা, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনাসহ অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা পান।

বিগত সময়ে সংরক্ষিত আসনে যাঁরা নারী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, দু–একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগের ভূমিকা সংসদে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দলের প্রতি আনুগত থাকা, বিরাগভাজন না হয়ে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আবারও মনোনীত হওয়ার সুযোগ খোলা রাখার জন্য বেশির ভাগ নারী সদস্য চুপ থাকাকেই ‘নিরাপদ’ বলে ভেবেছেন। এমনকি নারী নির্যাতনের আলোচিত ঘটনাতেও তাঁদের সংসদে খুব একটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।

নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন

একাদশ সংসদে (২০১৮ মেয়াদে) সংরক্ষিত আসনে বিএনপি মনোনীত একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন রুমিন ফারহানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫৩ বছর ধরে সময়ে–সময়ে নারী আসনসংখ্যা বাড়ানো হলো। কিন্তু নারী আসন কোনোভাবেই নারীর পথকে সুগম করেনি, প্রশস্ত করেনি। অনেক নেতা পরিবারের নারী সদস্যদের সেসব আসনে বসিয়ে সুবিধা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।’

নারীর প্রশ্নে গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নারীর স্বার্থ দেখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তারা বলছে, জুলাইয়ে নারীরা ছিল সামনের সারিতে। এই নারীদের আর হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীকে রাখতে হবে। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ রাখতে হবে।

নারী আসন নিয়ে নারীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হলেও তারা তা শোনেনি। কমিশন রাজনৈতিক দলকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। নারী আসন নিয়ে নারীদের দাবি পূরণের আর সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ দাবি পূরণে এখন নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হতে হবে।