Image description

গত বছরের এই সময়, জুলাইয়ের রৌদ্রতপ্ত দুপুর, শ্রাবণের আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা আর রিমঝিম বৃষ্টি এবং আতঙ্ক ঘন রাতগুলো একসাথে মিশে গিয়েছিল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নারী শিক্ষার্থীর জীবনে। ১১ জুলাইয়ে সারা বাংলাদেশে প্রথম পুলিশি হামলার শিকার হয় কুবি শিক্ষার্থীরা, তাদের রক্তে রঞ্জিত হয় 'ছাত্র-আন্দোলন চত্বর'। সেদিন পুলিশের রাবার বুলেট, টিয়ারগ্যাস আর লাঠিচার্জকে প্রতিরোধ করতে রাজপথে নেমে আসে কুবির নারী শিক্ষার্থীরা। সেদিনের আন্দোলনের পর দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে প্রতিবাদের ঢেউ খেলেছিলো। তখন থেকে কুবি ক্যাম্পাসেও জেগে উঠেছিল নারীদের সাহসী কণ্ঠস্বর। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর দমনের জন্য নেমে আসে টাইরান্নি প্রশাসনের  বিষাক্ত ছোবল।

সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই চীন সফর শেষে একটি প্রেস কনফারেন্সে বলেন 'কোটা'র সুবিধা মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পবে?' সেই বক্তব্যের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। একইভাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী হলগুলোতেও প্রতিবাদের স্ফুরণ ঘটে নারীদের কণ্ঠে। তারা সেদিন স্লোগান দিয়েছিলো 'আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার', 'কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার'।

১৫ জুলাই কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাদাৎ সায়েম তার ফেসবুক ওয়ালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে পোস্ট করে 'আসো খেলা হবে'। সেদিন রাতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলাও চালায়। ১১ থেকে ১৮ জুলাই এই দিনগুলো কেটেছিল অনিশ্চয়তায়, ভয় আর সাহসে। তখন হলে থাকা মানেই ছিল এক অসম যুদ্ধের মধ্যে দিনরাত পার করা।

আন্দোলনকারী ও হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আমেনা ইকরা বলেন, ‘রাতের পর রাত বিছানার পাশে দা-বঁটি নিয়ে ঘুমাতাম। মনে হতো, হামলা হবে, দরজা ভেঙে ঢুকবে কেউ। নিজের জীবন যেন নিজের কাছেই অনিরাপদ মনে হতো।’

১৮ জুলাইয়ের পরপরই সেই ভয়টাই বাস্তবে রূপ নেয়।

প্রশাসনের মৌন সম্মতি ও রাজনৈতিক নির্দেশে শিক্ষার্থীদের হল থেকে সিলগালা করে বের করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। রাত ৯টার পরে যাদের থাকার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কক্ষে, তারা সেদিন রাত কাটান খোলা আকাশের নিচে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে।

আমেনা ইকরা আরও বলেন, '১৮তারিখ পর্যন্ত হলে থেকে আন্দোলন করলেও উপর মহলের নির্দেশ ও রাজনৈতিক চাপে সেদিন বিশ্বরোডের রণক্ষেত্র থেকে আমরা হলে ফিরে ঠাঁই পাইনি। রাত ৯টায় আমাদেরকে বের করে সিলগালা করে দেওয়া হয় হল। শুরু হয় কোনোমতে বেঁচে থাকার লড়াই, কদিন খানবাড়ি কদিন দক্ষিণ মোড়ের এক মেসে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করি পরবর্তী কর্মসূচির। ধীরে ধীরে আমাদের ঠিকানা চিনে যায় রেজা-সায়েমের দল। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ তাদের নজরবন্দি হয়ে কেটেছে, ক্যাম্পাসে মানুষজন থাকায় সরাসরি কিছু তারা করতে না পারলেও, নবি মামার চায়ের দোকানে তারা প্রায় দিনই আমাদের পাশের টেবিলে বসতো আমাদের কথাবার্তা-গতিবিধি বুঝবে বলে। একদিন তো এমনও হয়েছে আড়চোখে দেখতে পাই তাদের ফোনে রেকর্ডার অন করা।'

এরপর শুরু হয় গোপনে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কেউ একদিন কাটান বান্ধবীর ছোট একটি মেসে, কেউ বা আশ্রয় নেন দূরের আত্মীয়ের বাসায়। ভোরে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি জমান বাড়ির দিকে।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের শিক্ষার্থী ও দৈনিক আজকের কুমিল্লা'র ক্যাম্পাস প্রতিনিধি চাঁদনী আক্তার বলেন, 'জুলাইয়ের দিনগুলো আসলে পার করার সময়ে মনে হয়েছিল যেন '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আছি। যেখানে ভার্সিটির হল মেয়েদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সেখানে হল ই হয়ে উঠেছিল অনিরাপদ। ১৮ জুলাই যখন প্রভোস্ট নোটিশ পাঠিয়েছে হল ছাড়ার জন্য এবং তিনি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলছেন, ছাত্রলীগ নাকি হলে ঢুকবে। তখন আমরা মেয়েরা পুরো বেকায়দায় পড়ে যাই। হুট করে কিভাবে বাসায় যাবো। তাছাড়া হল ছেড়ে যেতেও ইচ্ছা করছিলো না কারণ আমাদের ভাইয়েরা তখন ও রাস্তায় আন্দোলন করছে। নিরুপায় হয়ে তাৎক্ষণিক হল থেকে বের হয়ে বন্ধুর মেসে রাতে থেকে সকালে যখন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম তখন স্টেশন গিয়ে দেখি ট্রেন চলবে না। সব বন্ধ। অটো, সিএনজি, লোকাল বাস এবং পায়ে হেঁটেও বাসায় পৌঁছাতে পারিনি। আমার সাথে আমার বান্ধবী সহ আমরা মোট ৫ জন ছিলাম। বাসায় পৌঁছানোর উপায় না পেয়ে বান্ধবীর বাসায় থেকেছি টানা ৬ দিন। তখনকার সময়ে নেটওয়ার্ক ছিল না। দেশের অবস্থা জানতে টিভি দেখতাম সবসময়। আতঙ্ক উৎকণ্ঠা দিন পার করতাম। কখন জানি কি হয়ে যায় এই ভয় কাজ করতো সবসময়।'

৩ আগস্ট, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক দফা (শেখ হাসিনার পদত্যাগ) দাবি উত্থাপন করা হয়। সেদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উদ্‌গিরিত হয়৷ শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে সুনীতি-শান্তি নামে নামকরণ করে বিপ্লবী সেই নারী শিক্ষার্থীরা।

নারী হলের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী বিথী আক্তার বলেন, '১৮ জুলাই রাতে হঠাৎ করেই হল ছাড়ার নির্দেশ এলো। কোনো পূর্বাভাস ছিল না, ছিল না কোনো প্রস্তুতি। সবাই হতভম্ব। চোখের পলকেই নিজের জায়গা, পরিচিত মুখ, পড়ার টেবিল, সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হলো। চারপাশে অস্থিরতা, ভয়, আর উদ্বেগের ছায়া। মনে হচ্ছিল, বাতাসেও যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। নবাব ফয়জুন্নেছা হল থেকে বেরিয়ে হাতে কেবল একটি ছোট ব্যাগ। তাতে ছিল দু-একটা জামা আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন বাস্তবতা থেকে ছিটকে পড়েছি কোনো দুঃস্বপ্নে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বোবা পাথরের মতো ছিলাম। সামনে-পেছনে মানুষ ছুটছে, কেউ কাঁদছে, কেউ ফোন করছে আর আমার ভেতরটায় শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল: “আমি এখন কোথায় যাবো?”, কেউ বলছে, “ঘরে ফেরার রাস্তা নেই।”

তিনি আরও বলেন, 'পেছন থেকে মামারা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলছিলেন, “আপনারা দ্রুত এখান থেকে সরে যান, জায়গাটা নিরাপদ না।” কথাগুলো কানে বাজছিল, কিন্তু পা যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ছিল, তখনকার সময়ে হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসব জায়গায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ছিল অনেকটাই সাধারণ হয়ে গিয়েছিল। জীবন যেন প্রতিদিন একটা ঝুঁকি নিয়ে শুরু হতো। পরে অনেক কষ্টে শহরের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে একটু আশ্রয় পাই।' 

'জুলাই বিপ্লব' ছিল কুবির ইতিহাসে এক ত্যাগ ও সাহসের অধ্যায়। কিন্তু সেই অধ্যায়ের অন্তরালে নারী শিক্ষার্থীদের জীবন ছিল এক অবর্ণনীয় লড়াইয়ের রূপকথা- যা রূপকথা হলেও সুখের ছিল না। তারা রুখে দাঁড়িয়েছিল, ঝুঁকি নিয়েছিল, অথচ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল তাদেরই।

আন্দোলনের ইতিহাস হয়তো রাজনৈতিক পরিসরে বিচার হচ্ছে এবং হবে, কিন্তু রাত্রির নিস্তব্ধতায়, বন্ধ দরজার আড়ালে, কিংবা রাস্তায় হঠাৎ থেমে যাওয়া গাড়ির নীচু গিয়ারের শব্দে, একটি প্রজন্মের নারীরা যে ভয় আর প্রতিরোধ বুকে নিয়ে হেঁটেছে, তা রয়ে যাবে এক অশ্রুত দলিল হয়ে।