
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু প্রশাসনে এখনো আসেনি কাঙ্ক্ষিত গতি। দায়িত্ব নেয়ার পর চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলেও গণ-অভ্যুত্থানের পর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী প্রশাসন এগোচ্ছে না বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা ও সাবেক আমলারা।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ৮ই আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো জুলাই আন্দোলনের গণ-আকাঙ্ক্ষা ছিল জনমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলা। তবে সামপ্রতিক সময়ে এসব মন্ত্রণালয়ের অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সেই প্রত্যাশাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে, প্রশাসন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী জানতে চাইলে-জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ, মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া মানবজমিনকে বলেন, প্রশাসনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। বর্তমান প্রশাসন দিয়ে গত এক বছরে মানুষের কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ হয়নি। এ রকম দুর্বল প্রশাসন স্বাধীনতার পর আর হয়নি বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ। এই প্রশাসনের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাও বাস্তবায়ন দেখছি না।
সাবেক আমলা ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঠিক পরামর্শ দিতে পারেননি। তারা দিয়েছেন ভুল পরামর্শ। যাদের নেয়া হয়েছে তারা মেধাবী হতে পারেন, কিন্তু প্রশাসন বিষয়ে তারা দক্ষ নন এবং প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণাবলি তাদের নেই।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর হতে চললেও এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনে। চতুর্মুখী দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে বিপর্যস্ত প্রশাসন। প্রশাসন এখন অনেকটাই স্থবির। সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না নাগরিকরা। ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেও সেবা নিতে নাগরিকদের সমস্যা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে নাগরিকদের দিক থেকে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে আগের সরকারের নিয়োগ দেয়া প্রায় সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নজিরবিহীন অরাজকতা সৃষ্টি হয় প্রশাসনে। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সামপ্রতিক সময়ে তা প্রথম দিকের বিশৃঙ্খলাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সচিবালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত একবছরে সরকার পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কয়েক দিন পরপরই পরিস্থিতি হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। কাউকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে। উল্টোদিকে বঞ্চনার শিকার বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি প্রশাসনের নেতৃত্ব দেয়া কর্মকর্তারা। ঢালাও পদোন্নতির সুযোগে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের লাভবান হওয়ার অভিযোগ আছে অহরহ। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নিতে উদ্যোগ নেয়া হলেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে খুব বেশি সাড়া মেলেনি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মানবজমিনকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর হলো। কিন্তু মানুষের যে বিশাল আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রশাসনের কাছে তা পূরণ করতে পারেনি। তিনি বলেন, প্রশাসনে অনেক সিদ্ধান্তহীনতা দেখছি যেটা মানুষকে হতাশ করেছে। বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তো প্রশাসনকে ওই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, সব জায়গায় ভয়ের পরিবেশ চলছে। মব সন্ত্রাসের ভয়ে অস্থির। মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। সচিবালয়ের মতো জায়গায়ও আমরা দেখছি মব তৈরি করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এজন্য প্রশাসনসহ সব জায়গায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রশাসনে গতি ফেরাতে সরকারের করণীয় বিষয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, নেতৃত্বের পর্যায়ে রদবদল এনে তাদের মেসেজ দেবেন। কাজে উৎসাহিত করবেন, তাদের সুরক্ষা দেবেন। তারা যাতে আইনানুযায়ী কাজ করে সেই পরিষ্কার বার্তা তাদের দিতে হবে। আপনি তাদের মনিটর করবেন। সেখানে নেতৃত্বের প্রচণ্ড দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে।
গত একবছরে প্রশাসনের কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ বলেন, প্রশাসনকে গত একবছরে গতিশীল করা সম্ভব হয়নি। ১৫ বছরের একটি রিজিম ছিল, সেভাবে প্রশাসনও সাজানো ছিল। প্রশাসনের সবাই খারাপ না বা অদক্ষ না। ভালো লোকও আছে। তাদের কাজ বা রিপোর্ট দেখে মূল্যায়ন করতে হবে। যারা রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ বা দালালি করে তাদের বাদ দেয়ার পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক। তিনি আরও বলেন, পুলিশের ক্ষেত্রে আরও ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্যদিকে, এই সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই প্রশাসনে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সেই ধারা এখনও বহাল রয়েছে। শুরুতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে নজরবিহীনভাবে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রতিবাদের মুখে ১১ই সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত, উপ-সচিব থেকে যুগ্ম সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপ-সচিব পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। অভিযোগ ওঠে এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় মামলায় পেয়েছিলেন শাস্তি। কেউ কেউ ছিলেন পতন হওয়া আওয়ামী লীগের নানা অপকর্মের সহযোগী বিগত সরকারের পথ অনুসরণ করে ঢালাওভাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি, চুক্তিভিত্তিক ও সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ অব্যাহত রেখে আলোচনার জন্ম দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়ে তাদের তুষ্ট করার অভিযোগও উঠছে নানা মহলে। এ ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা বাস্তবায়নের নির্দেশনা থাকলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফেব্রুয়ারিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণার পরও মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজাতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নির্বাচনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ডিসিদের নিয়োগ এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। অনেক জেলায় পদোন্নতিপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবরা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও নতুন নিয়োগ আটকে রয়েছে। ফলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ধীর গতির কারণে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
গত এক বছরে প্রশাসন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গায় কতোটুকু পূরণ করতে পেরেছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সীমিত সম্পদ ও সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রকে ভালোভাবে রাখার ও চলার চেষ্টা করেছি। আরও বড় সম্পদ থাকলে আরও ভালো রাখা যেতো। তিনি বলেন, আরও কিছু করা উচিত ছিল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, এই সরকার প্রস্তুত ছিল না। নতুন নতুন মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসাতে হয়েছে। তিনি বলেন, কথায় কথায় ঘেরাওয়ের মতো পরিস্থিতিও হয়েছে। তা সত্ত্বেও কাজ করে গেছি। সরকারের অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এটুকুও করতে পেরেছি, এ জন্য আলহামদুলিল্লাহ।