Image description
 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি খুব একটা চোখে পড়েনি। গত এক বছরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল মব ভায়োলেন্স বা মব জাস্টিস। সংঘবদ্ধ এই অপরাধ চোখ রাঙিয়েছে বছরজুড়েই। পিটিয়ে হত্যার কয়েকটি ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। এর বাইরে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও খুনের মতো নিয়মিত অপরাধও চলেছে সমানতালে। ঠুনকো ঘটনা কিংবা ছোট্ট দাবি আদায়েও সড়ক অবরোধ থেকে থানা ঘেরাওয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট পর্যন্ত কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। গণবিস্ফোরণের মুখে পুলিশ বাহিনীও থানা ও স্থাপনা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যায়। এতে ওই সময়ে দেশজুড়ে চলে কার্যত অরাজকতা। যদিও সরকার গঠনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নানা চেষ্টা চোখে পড়েছে। তারপরও জনমনে কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি আসেনি।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের অনেক স্থাপনা ও যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কয়েকজন পুলিশ নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা অনেক থানা, ফাঁড়ি ও স্থাপনা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগছে। যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর।

 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো ছিল, তা পুলিশ কর্মকর্তারাও জোর দিয়ে বলছেন না। ভালো না থাকার পেছনে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন তারা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘২০২৪-এর অভ্যুত্থানে পুলিশ থানা ছেড়ে, স্থাপনা ছেড়ে পালিয়েছে। কারণ, বিগত সরকারের আমলে নানা কর্মকাণ্ডে এই পুলিশ জনগণের কাছে ঘৃণীত হয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেইরকম একটা বাহিনী এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেলবে, সেটা তো সম্ভব না।’

 
 

তিনি বলেন, ‘ভেঙে পড়া একটি বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রয়েছি। এর মধ্যেই তাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হচ্ছে। এখন কতটুকু পেরেছি, সেটা মানুষই বলবে।’

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল, সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এই সময়টায় নানা ধরনের আতঙ্ক, ভয় ও উত্তাপের মধ্য দিয়ে গেছে। জনগণের মধ্যে নানা শঙ্কা ছিল।

১০ মাসে ২৮৮৫টি খুনের মামলা: সাধারণত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ধারণা নিতে খুনের পরিসংখ্যান বেশি বিশ্লেষণ করা হয়। বর্তমান সরকারের এক বছরের মধ্যে ১০ মাসে সারা দেশে খুনের মামলার তথ্য পেয়েছে কালবেলা, যা পুলিশ সদর দপ্তর তৈরি করেছে। এ পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত—এই ১০ মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৮৮৫টি খুনের মামলা হয়। সে হিসাবে মাসে গড়ে ২৮৮ জনের বেশি এবং প্রতিদিন গড়ে ৯ জনের বেশি মানুষ খুন হয়েছেন। এসব মামলার মধ্যে গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে সারা দেশে খুনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩৬১ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ১ হাজার ৫২৪টি খুনের মামলা হয়। এর মধ্যে আগস্ট মাসে ৬১৮ জন, সেপ্টেম্বরে ২৮৩, অক্টোবরে ২৪৯ ও নভেম্বরে ২১১ জন খুন হন। ওই চার মাসের পরিসংখ্যান বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধীরে ধীরে খুনের মতো ঘটনা কমে এসেছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে খুনের ঘটনায় সারা দেশের থানাগুলোতে ২৯৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ২১৭টি, মার্চ মাসে ২৩৯টি, এপ্রিলে ২৬৪টি, মে মাসে ২৬১টি এবং জুনে ২৪৯টি মামলা হয়।

মব ভায়োলেন্সে আতঙ্ক, ১১ মাসে প্রাণ কেড়েছে ৭৮৯ জনের: মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে ৭৮৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে ৫৩ জন, সেপ্টেম্বরে ৮১ জন, অক্টোবরে ১০০ জন, নভেম্বরে ১১৪ জন এবং ডিসেম্বর মাসে ১২৮ জন প্রাণ হারান। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৭ জন, মার্চে ৪৭ জন, এপ্রিলে ৬৫ জন, মে মাসে ৭৮ জন এবং জুন মাসে ৮৯ জন প্রাণ হারান মব ভায়োলেন্সে।