Image description
 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিন দিন পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। গত এক বছরে এই সরকার জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের সহায়তা, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নানা উদ্যোগ নেয়।

দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে করা মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত; ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্ত করা; গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন; ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য ফাউন্ডেশন গঠন; নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া; জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা; বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।

এর বাইরে আর্থিক খাত সংস্কার ও দুর্নীতি দমনেও সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। নির্বাহী আদেশে নয়, গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল করা হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করাসহ বিভিন্ন খাতভিত্তিক নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়।

 

গত এক বছরে মুক্তি পেয়েছেন প্রায় ৮ হাজার রাজনৈতিক বন্দি, যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে আটক ছিলেন। বিক্ষোভ দমনকালে সেনা-পুলিশের গুলিতে দেড় হাজার জন নিহত হওয়ার ঘটনার বিচারের দাবি জোরালোভাবে উঠে আসে। সাবেক সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ‘ট্রাইব্যুনালে’র আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে।

 
 

সংস্কার কমিশন গঠন করে ৩০টির বেশি দলের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি এবং ঐতিহাসিক জুলাই সনদকে চূড়ান্ত করা এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের যে কোনো প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা; পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে গত এক বছরে ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

 

প্রবাসীরা প্রথমবারের মতো ভোটার এবং নারীদের অন্তর্ভুক্ত করে অবাধ, সুষ্ঠু এবং উৎসব নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনকে গণতন্ত্রের জাতীয় উৎসবে পরিণত করার লক্ষ্যে নাগরিকদের প্রতিক্রিয়ার জন্য ডিজিটাল পরামর্শ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রায় ৮ লাখ পুলিশ, অনিয়মিত আনসার ও সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে।

শিল্প খাতের উন্নয়ন, প্রসার, নতুন নীতি ও কৌশল গ্রহণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা পরিচালনার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতি সহায়তা দিয়ে একটি শক্তিশালী শিল্প খাত গড়ে তুলতে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

দেশের দ্রব্যমূল্যের বাজারে একটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তর দেখা গেছে। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল এবং ব্যবসা পরিচালনার সহজতর পরিবেশ তৈরি করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কঠোর মনিটরিং, পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং চাঁদাবাজি রোধে কার্যকর উদ্যোগের ফলে এই সাফল্য এসেছে।

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে সরকার। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে চাল ও গম মিলে মোট ২১ লাখ ৩১ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের সব শহীদ ও আহতের তালিকা সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছে। ৭৭৫ জন শহীদ যোদ্ধা পরিবারকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও ভাতা প্রদান এবং ১৩ হাজার ৮০০ জন আহত যোদ্ধাকে ১৫৩ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়।

সংস্কারমুখী নিয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশে মানবাধিকার সেল, বডিক্যাম, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ এবং জনসাধারণ যাতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তা ছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে ব্যাপক পরিবর্তন, গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবারকে জানানো, আইনজীবী ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিতকরণ এবং অনলাইন জিডি চালু করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল বাণিজ্য শুল্ক আলোচনা শেষ হয়েছে, বড় আকারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষিত করেছে এবং গত সরকারের সময়ের তুলনায় প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ দ্বিগুণ হয়েছে। চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসছেন। দেশের বিমান পরিবহন খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে নীতিগত সংস্কার, উন্নত বিমান পরিষেবা, বিমান যোগাযোগ বৃদ্ধি, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কার্গো পরিচালনার কৌশলগত সম্প্রসারণ।

বঙ্গোপসাগরকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে ‘পানিভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, গভীর সমুদ্র মৎস্য ও শিল্প প্রকল্পে বৈশ্বিক অংশীদারদের নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গত এক বছরে প্রায় ১৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বৈদেশিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আদানি পাওয়ারের বকেয়া ছিল ৭ হাজার ৯৩৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সেখান থেকে বর্তমানে বকেয়া রয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (এনটিসিসি) পুনর্গঠন এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা ফের চালু হয়েছে ও মালয়েশিয়ায় মাল্টিপল অ্যান্ট্রি ভিসা নিশ্চিত হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে অনিবন্ধিত শ্রমিকদের বৈধকরণ, ১ লাখ তরুণকে জাপানে পাঠানোর পরিকল্পনা এবং ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সার্বিয়ায় আরও শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, সমালোচনার স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।