Image description
 

সুপ্রিম কোর্টের হাতে একক ক্ষমতা গেলে এখানেও দানবের সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে দেওয়া হলে, বিচারকদের দানবীয় আচরণের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারব না।’

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল শুনানিতে অংশ নিয়ে বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন। বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ চন্দ্র রায়ের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি হয়।

সোমবার (১১ আগস্ট) এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য করা হয়েছে।

 

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সমাজে, বিচারব্যবস্থা বা সরকারি ব্যবস্থা যেকোনো এক জায়গায় ক্ষমতা দিলে, সেই ক্ষমতাটা দানবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আজকে যদি সুপ্রিম কোর্টের কাছে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়, এখানেও দানবের সৃষ্টি হবে।’

 

তিনি বলেন, ‘সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় করার। ইতিমধ্যে সরকার এটা বলেছেও। একজন বিচারকের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি একটা প্রশাসনিক কাজ। এই কাজগুলো হয়ে থাকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। আমরা মনে করি, এই বিধান সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি নয়। এই বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করেছে।’

 

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বাস্তবে একজন সহকারী জজের বদলিও একা আইন মন্ত্রণালয় করতে পারে না। কারণ, এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায় সুপ্রিম কোর্টের জিএ (জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কমিটির কাছে। এরপর জিএ কমিটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেয়। এটাই হলো ক্ষমতার ভারসাম্য।’

তিনি বলেন, ‘সরকার এখন কী করছে? অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতা করছে। সেই জায়গায় কীভাবে এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় (বেসিক স্ট্রাকচারে) আঘাত করছে, সেটার বর্ণনা রিটে দেওয়া হয়নি। শুধু বললাম, বেসিক স্ট্রাকচারে আঘাত করছে, সেই বলাটাই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে সঠিক যুক্তি থাকতে হবে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, কর্মস্থল নির্ধারণ, ছুটি, শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যের বিধান আনা হয়েছে, সেটা সংবিধানের কোন বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কোন বেসিক স্ট্রাকচারকে আঘাত করছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। কোনোটাই এই রিটে উল্লেখ করা হয়নি।’

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা যুক্তি টেনে বলেন, ‘বায়াত্তরের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। পরবর্তীতে সেটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে নেওয়া হয়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা ফের সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া সম্ভব নয় বলে রায় দিয়েছেন। তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে না রাখা গেলে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার বিদ্যমান বিধান রাখা সম্ভব নয় কেন? বেসিক স্ট্রাকচারের অর্থ এই নয় যে বায়াত্তরের সংবিধানে যা আছে, তাই থাকতে হবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে যে ক্ষমতা, ১১৪ অনুচ্ছেদে যে সুপারভাইজিং অথরিটি তা সুপ্রিম কোর্টের থাকছে। তারপরও ১১৬ অনুচ্ছেদে যে ফাইল চালাচালির ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টকে সহযোগিতার ক্ষমতা, ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টা, কর্তন করতে কেন হবে? বিগত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, আইন মন্ত্রণালয় একজন সহকারী জজকেও অন্য কোথাও বদলি বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ছাড়া। অধস্তন আদালতের একজন বিচারক চিন্তা করবে, আমি সুপ্রিম কোর্টের একক হাতে বলিদান হওয়ার থেকে আমাকে মন্ত্রণালয় রক্ষা করবে। আবার মন্ত্রণালয় বলিদান দিতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট রক্ষা করবে। এই যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স, এটা কেন নষ্ট করতে হবে?’

তিনি বলেন, ‘শুধু সুপ্রিম কোর্টের হাতে ক্ষমতা এলে, তখন একজন অ্যাডিশনাল রেজিস্ট্রার বা রেজিস্ট্রার ফাইল উপস্থাপন করবে, তাই দেখে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। কারণ, আপনার হাতে আর কোনো ম্যাকানিজম নাই। এজন্য বারবার আসছে ষোড়শ সংশোধনীর কথা। গত ৫০ বছরে আমাদের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের কারণে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে মনে করা হলো, সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়, বায়াত্তরের সংবিধান মেনে সেটা হবে বিপর্যয়। বেসিক স্ট্রাকচার মানে বাহাত্তরের সংবিধানে যেটা আছে সেটা না। বেসিক স্ট্রাকচার হচ্ছে, আমি আমার মানুষের মর্যাদা, ন্যায় বিচার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, এটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেটা করব, সেটাই বেসিক স্ট্রাকচার।’

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কথা উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় একজন বাদে আটজন অ্যামিকাসকিউরি বললেন, এই সংশোধনী গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করছে না। রায়ে সাতজন বিচারপতির মধ্যে চারজন বললেন, এটা সংবিধান বহির্ভূত। তিনজন বিচারপতি বললেন, এটা সংবিধান সম্মত। এটা মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে না। এজন্য বলছি, মৌলিক কাঠামো নীতি তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করতে হলে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে মাথায় নিতে হবে। কারণ, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা যে ভুল ছিল এটা প্রমাণিত হয়েছে। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে যে স্তম্ভ দাঁড় করানো হলো, সেটাই ছিল বেস্ট অপশন।’

তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় দেওয়ার পর গত ১৬ বছরে দেশে সাড়ে ৪ হাজারের মতো মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। সাত শতাধিকের বেশি মানুষ গুম হয়েছেন। ৬০ লাখের বেশি মানুষ রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। জুলাই বিপ্লবে মাত্র ৩৬ দিনে দেড় হাজারের অধিক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গত ১৫-১৬ বছরে লাখ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন। একটা রায়ের কারণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ে গোঁজামিল দিয়ে মৌলিক কাঠামো নীতি তত্ত্বকে বহাল রাখা হয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিলের রুল শুনানিতে আমাদের আপত্তি এখানেই।’

রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিটটি করেন।

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং এ-সংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচার বিভাগীয় পৃথক সচিবালয় কেন প্রতিষ্ঠা করা হবে না, রুলে তা–ও জানতে চাওয়া হয়।

রিট আবেদনকারী সাত আইনজীবী হলেন, মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল ও যায়েদ বিন আমজাদ।

রিট আবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে’ শব্দগুলো যুক্ত করা হয়। আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও ১১৬ অনুচ্ছেদের ওই বিধান বহাল রাখেন।