Image description

ব্যাংক খাতে লুণ্ঠন , অর্থ পাচার , শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নড়বড়ে করে ফেলা , বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে চাপ ইত্যাদি কারণে আওয়ামী লীগ আমলের শেষের দিকে অর্থনীতি মহাসংকটে পড়েছিল । এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জনজীবনেও । মূল্যস্ফীতিতে দেশবাসীর নাভিশ্বাস ওঠে । ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই বেহাল অর্থনীতিকে পথে আনা । পর্যবেক্ষকদের মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য রয়েছে , আর্থিক খাতেই অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সবচেয়ে সফল । বিশেষ করে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনায় সাফল্য পেয়েছে ড . ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ।

দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা উদ্যোগ নেয় সরকার । ব্যাংকিং আইন সংশোধন , কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান , রেমিট্যান্সের রেকর্ড সংগ্রহ , ডলারসংকট দূর হওয়া , বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি , বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং তারল্যসংকট সমাধানের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপে অর্থনীতিতে স্বস্তি এসেছে ।

নথিপত্র বলছে , দেশের দ্রুত কমে আসা রিজার্ভ গত এক বছরে তরতরিয়ে বাড়ছে । এর নেপথ্যে মূল অবদান প্রবাসীদের । তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছেন । ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রিজার্ভ এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার । আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার ।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার । গত বছরের ২ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার । অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ঘাটতি থেকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৯৮ কোটি ডলার । ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি ঘাটতি ছিল ৬৫১ কোটি ডলার ।

গত জুন শেষে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩২৯ কোটি ডলার । আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল । অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ ছিল । সরকার বদল হওয়ায় প্রকৃত হিসাব প্ৰকাশ পাচ্ছে । অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরুতে ১০ টির বেশি ব্যাংক, ১৫ টির মতো নন - ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ( এনবিএফআই ) এবং কিছু বিমা কোম্পানি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় । টাকার হাহাকার রোধের স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক । আর সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিতে গত ৩০ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয় । এর মাধ্যমে গ্রাহক সঞ্চয়ের কমপক্ষে ২ লাখ এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ফেরত পাবেন । আগে কোটি টাকার আমানতধারীও ফেরত পেতেন সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা । ব্যাংককে দেওয়ার জন্য টাকা ছাপানো হবে না বলেও দেওয়া অঙ্গীকারটি অবশ্য রাখতে পারেনি সরকার । কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুবাদে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে । সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে ।

গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৯ শতাংশ । চলতি বছরের জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ । পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত বছরের আগস্টে তা ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ । ব্যাংক খাত ঢেলে সাজাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে । ডজনখানেক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে । তার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলমের যথেচ্ছাচারে বিপর্যস্ত দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ । ব্যাংকটি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর । ব্যাংকিং আইন সংশোধন করা হয়েছে । পরিচালকদের মতামত গোপন করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে । আদালতের মাধ্যমে শত শত খেলাপির বন্ধকি সম্পদ ব্যাপকহারে নিলামে তোলা হচ্ছে । রাজনৈতিক পালাবদলে লুকানো খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় তা হু হু করে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকায় । খেলাপি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের মেয়াদ পার হওয়ার মাত্র ৯০ দিনে তা খেলাপি দেখাতে বলা হয়েছে । আগে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে কৌশলে ২১ বছর পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা যেত । ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো ( সিআইবি ) সার্ভারে খেলাপির তথ্য হালনাগাদের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিতে যাচ্ছে ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ( এফআইডি ) অযাচিত ক্ষমতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরে স্বাধীন ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে । অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রের হিসাব অনুযায়ী শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ( ২৮ লাখ কোটি টাকা ) ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে । হাসিনা সরকারের পতনের পর নাগরিক সমাজের তরফ থেকে পাচারের অর্থ ফেরত আনার দাবি ওঠে । তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন , বিষয়টি মোটেই সহজ হবে না । পাচারের অর্থ ফেরাতে এ পর্যন্ত ৯ টি দেশকে চিঠি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার । সেই সূত্রে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা কিছু ব্যক্তির অর্থ লেনদেনে নিষেধাজ্ঞার ঘটনা ঘটেছে । এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন , ‘ পাচার করা অর্থ ফেরত আনার সহজ কোনো রাস্তা নেই । কারণ , পাচার হওয়া অর্থের যোগসূত্র প্রমাণ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ । ”