
দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে পুলিশ বাহিনীর মুখ্য কাজ। পুলিশিং হওয়ার কথা ছিল জনবান্ধব। কিন্তু যুগের পর যুগ সেই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে—সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় গিয়েছে, তখন সেই সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ বাহিনীকে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিগত ১৫ বছরে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তলা হয়েছে। সর্বশেষ গত বছর (২০২৪) জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ হতাহত হন। এ আন্দোলনে পুলিশের দমন-পীড়নে পুলিশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। যে কারণে পুলিশে সংস্কারের জোর দাবি ওঠে সব মহল থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটা খুবই উদ্বেগজনক। এ ধারণা দূর করেতে হবে। তবে এরইমধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কারে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটা প্রশংসনীয়।
অন্তর্বর্তী সরকার আমলেই যে পুলিশের সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তা নয়। ১৭৯২ সাল থেকেই বিভিন্ন সময় পুলিশ সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ আমলে এরশাদ সরকারের সময় চার দফায় পুলিশ সংস্কারে কাজ করা হয়।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে ফৌজদারি আইন সংস্কার কমিটির মাধ্যমে কিছু বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। পরে ১৯৮৩ সালে ব্রিগেডিয়ার এনাম কমিটি নামে আরেকটি কমিটি করা হয়। সেখানেও কিছু সুপারিশ আসে। তৃতীয় দফায় ১৯৮৮ সালে বিচারপতি আমিনুর রহমান পুলিশ কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। তারাও পুলিশ সংস্কারের বিষয় তুলে ধরে ৩২৮ পৃষ্ঠার একটি বিশাল প্রতিবেদন দিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে একই উদ্দেশ্যে আবার এক সাবেক আমলা মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের আগে ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম চলে। ২০০৭ সালে একটি খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশও হয়েছিল। সব কমিশন ও কমিটিই বাংলাদেশে একটি দক্ষ, মানবিক, যুগোপযোগী ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গঠনের ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনে দেখা গেছে পুলিশের এক ভয়ংকর রূপ। যার কারণে ওই বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের নৃশংসতার বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়।
পরে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিশন চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ৩৫৫ পৃষ্ঠার একটি সংস্কার প্রতিবেদন তুলে ধরে সরকারের কাছে। তারা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু সুপারিশ করে প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ পর্যালোচনা ও বাস্তবায়নে গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টরা। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়ার সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সুপারিশ বাস্তবায়ন বিষয়ক বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, পুলিশ সংস্কার কমিশনের ১১টি সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত দিয়ে কোন দফতর কোনটি বাস্তবায়ন করবে সেটা বলা হয়েছে। এই ১১টি বিষয় হচ্ছে—এক. থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু, তদন্ত ও পুলিশ ভেরিফিকেশন। দুই. আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ। তিন. বেআইনি সমাবেশে বল প্রয়োগ। চার. মানবাধিকার। পাঁচ. পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা বা ইউনিট শক্তিশালীকরণ। ছয়. নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি। সাত. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা। আট. যুগোপযোগী আইন ও প্রবিধানমালা। ৯. প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী। ১০. ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং ১১. বিবিধ পর্যবেক্ষণ।
সুপারিশ বাস্তবায়ন-বিষয়ক বৈঠকে থানায় জিডি ও মামলার এফআইআর গ্রহণে কোনোভাবেই অনীহা কিংবা বিলম্ব না করার কথা বলা হয়েছে। বেআইনি সমাবেশে বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত কৌশল বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর বল প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। অন্যান্য বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে বলা হয়েছে—এসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আন্তরিকতার সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পুলিশে সংস্কার কতদূর এমন প্রশ্নে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তার কমিশন এরইমধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের কাছে। এখন দায়িত্ব সরকারের। এর বাইরে আর কোনও বক্তব্য নাই তার। অপরদিকে, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশনের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো—একটা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের জন্য সবাই একমত হয়েছে। আর এমন একটা স্বাধীন কমিশন হলে পুলিশ এবং অন্যদের মধ্যে ভবিষ্যতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তাদের দিয়ে যে সরকার বিভিন্ন অপকর্ম করায়, সেখান থেকে অন্তত সরকারি প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এটা একটা বড় সাফল্য। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে যেভাবে নির্বিচারে গুলি করেছে পুলিশ, সেটার ওপর কমিশনের যে সুপারিশ, সেটা অনুযায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই বাস্তবায়ন শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ থেকে লিথাল উইপন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাচিভমেন্ট আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভবিষ্যতে একটা পেশাদার পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’