
রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশ করা হবে। জুলাই আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে। বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করে এর একটি দফায় বলা হয়েছে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশ করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গতকাল ২৮ দফার এ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের আগে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা ও জুলাই শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের বর্ষপূতি উপলক্ষে ‘৩৬ জুলাই’ উদযাপনের অনুষ্ঠানে হাজারো ছাত্র-জনতার উপচেপড়া ভিড় ছিল। জাঁকজমকপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই ঘোষণাপত্রের ২৮টি ধারার শুরুর চারটিতে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশে বাকশাল গঠন এবং তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতা, সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের কথা বলা আছে। ৬ থেকে ৭ ধারায় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয় বলে উল্লেখ আছে।
ঘোষণাপত্রে জুলাই আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে যুক্তিসংগত, বৈধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে। জনগণের দাবি অনুযায়ী অবৈধ দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার গঠন করা হয়।
একদলীয় স্বৈরাচারী বাকশালের বিষয়ে জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়।’
৮ থেকে ১৫ ধারায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের ঘটনাপ্রবাহ, গুম, খুন, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, বিগত তিন নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার হরণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়।
ঘোষণায় শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিষয়ে বলা হয়, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একটি দলের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। শেখ হাসিনার অর্থনীতি ধ্বংসের বিষয়ে বলা হয়, ‘তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থপাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে।’
১৬ থেকে ২০ ধারায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথা, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালায়। ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ যোগদান করে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হামলায় এক হাজার মানুষ মারা যায়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন দেন বলে উল্লেখ করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলনে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনরত সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
জুলাই ঘোষণায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক এবং আইনিÑউভয় দিক থেকে যুক্তিসংগত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জনগণের দাবি অনুযায়ী অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সরকার গঠিত হয়।
২১ থেকে ২৮ ধারায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে বলা হয়Ñজনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। যেখানে রয়েছে বিগত আওয়ামী লীগের ১৬ বছরকালে আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালীন সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধগুলোর দ্রুত বিচার।
ঘোষণাপত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণার পাশাপাশি শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়। বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসংগত সময়ে অনুষ্ঠেয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে ঘোষণাপত্র রাখবে, যেটি গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উন্মুক্ত মঞ্চে উপস্থিত ছিলেনÑবিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপি সভাপতি নাহিদ ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাস, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি, এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
সূচনা বক্তব্য দেন জুলাই আন্দোলনের শহীদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি। অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা, জুলাই শহীদদের পরিবারের সদস্য, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, তিন বাহিনীর প্রধানসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান ও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও মিশনপ্রধানরা অংশ নেন।