Image description

রাতে প্রকাশ্যে ১২/১৫ জনের দুর্বৃত্তদের দল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ‘মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের’ সামনে গাড়ি আটকে দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে। হামলাকারীদের কেউ ছিলেন মাস্ক পরা, কারো মাথা ছিল হেলমেটে ঢাকা।

শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাত পৌনে ১১টার দিকে যখন এ হামলার ঘটনা ঘটে তখন সড়ক সচল, যানবাহনও চলছিল। কিন্তু দুই ব্যবসায়ীর বাঁচার আকুতি-চিৎকারে কেউ এগিয়ে আসেননি। অথচ খুব নিকটেই ছিল পুলিশের ফাঁড়ি, সামনে-পেছনে ছিল ট্রাফিক বক্সও।

দুর্বৃত্তদের এক থেকে দেড় মিনিটের অতর্কিত হামলার শিকার দুই ব্যবসায়ী হলেন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্লান) যুগ্ম সদস্য সচিব এহতেসামুল হক।

পরে তাদের উদ্ধার করে পাশের পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাতে ও পায়ে মারাত্মক জখম নিয়ে এহতেসাম এখনো হাসপাতালে ভর্তি। আর হাতে জখম হওয়া দীপুকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনার একটি ১০-১২ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে চাপাতি দিয়ে কোপানোর নৃশংসতা ফুটে উঠেছে।

রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকায় দুই ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কোপানোর ঘটনায় শনিবার (১১ জানুয়ারি) দুপুরে মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের সামনে মানববন্ধন থেকে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসায়ীরা।

তবে ওই ঘটনায় শনিবার (১১ জানুয়ারি) রাত ৯টা পর্যন্ত নিউমার্কেট থানায় কোনো মামলা নথিভুক্ত হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি হামলাকারীদের কেউ।

ভুক্তভোগী আহত ব্যবসায়ী ওয়াহেদুল হাসান দীপু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা একসঙ্গেই ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) অফিস থেকে বের হয়েছি। ওনার বাসা জিগাতলায়। কখনো সায়েন্স ল্যাবের সামনে থেকে উনি রিকশা নিয়ে চলে যান। কাল রাতে উনি হেঁটে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। আমি বের হই গাড়ি নিয়ে। সঙ্গে ছিল দুজন বন্ধু আর ড্রাইভার। ড্রাইভার যখন সামনে যাচ্ছিল মুখোশ পরা একজনকে দেখি রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। আমার গাড়ি যত সামনে যাচ্ছিল ওই মুখোশধারী তত কাছে আসছিল। আমি যখন ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি ব্যাক করো। এর মধ্যেই দৌড়ে এসে গাড়িতে কোপানো শুরু করল। সামনেই এহতেসামুল হককে কোপানো হচ্ছিল। উনি বারবার বাঁচান বাঁচান বলে চিৎকার করছিলেন। আমার গাড়িতেও কোপানো হচ্ছিল। আমি তখন নিজেই দৌড়ের ওপরে।

dhakapost
হামলার শিকার দুই ব্যবসায়ী ওয়াহেদুল হাসান দীপু ও এহতেসামুল হক

তিনি বলেন, ওদের (হামলাকারীদের) এলোপাথাড়ি কোপে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায়, লুকিং গ্লাস খুলে যায়। দরজা খোলার চেষ্টা করে। আমি লাথি দিয়ে একজনকে ফেলে দিই। এরপর দৌড়ে নেমে মাল্টিপ্ল্যানে ব্যবসায়ী অফিসে ঢুকে পুলিশকে ফোন করি, ৯৯৯-এ ফোন করে জানাই।

দীপু অভিযোগ করেন, চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে। ২০/২২ জনের মতো ওরা ছিল। বেশ কয়েকজন হামলায় অংশ না নিয়ে দাঁড়িয়েছিল পকেটে হাত দিয়ে। হয়ত ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সুযোগ পেলে গুলি করে দিত।

হামলা করল কারা– জানতে চাইলে এই ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে এটা পরিকল্পিত হামলা। এটা ব্যবসায়িক এলাকা। এখানে প্রচুর চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। কারা চাঁদাবাজি করে সেটাও সবার জানা। আমি আর কি বলব। হামলা তো হলোই, বললে আরও চাপ, হামলার শঙ্কা থেকে যায়। আপনারা সাংবাদিক-পুলিশ খুঁজে বের করেন কারা এসব করছে। আমার মনে হয়, লোকাল সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীর কোনো দল থাকতে পারে না। আগে ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেনি।

চাঁদাবাজি নাকি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে হামলা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট এলাকায় চিহ্নিত চাঁদাবাজ আছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে। আমি কারো নাম বলতে চাই না। আমি মনে করি আমার সঙ্গে অন্য কোনো ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

তবে দীপু সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, ৫ আগস্টের আগে যারা এই মার্কেটের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি, কাজ নেওয়া, দখলদারিত্ব বজায় রাখার কাজে যারা জড়িত ছিলেন, তারাই এ হামলা করে থাকতে পারেন।

একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নতুন গ্রুপের হাতে চলে যায়। তারাই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি দখল করে নেয়। এই গ্রুপ মোহাম্মদপুর এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরই আবার প্রতিপক্ষ ধানমন্ডি কেন্দ্রিক একটি শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপ। ধানমন্ডির গ্রুপটিই এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। এরই জেরে এ নৃশংস হামলা।

দুই ব্যবসায়ী নেতার ওপর হামলাকারীদের বিচার চেয়ে শনিবার দুপুরে মার্কেট বন্ধ রেখে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন এলিফ্যান্ট রোডের কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা। তারা মার্কেটের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

dhakapost
হামলাকারীদের বিচার চেয়ে কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

বৃহত্তর এলিফ্যান্ট রোড ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে মূলত কম্পিউটারের ব্যবসা। সেখানে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। একটা ছোট বিজ্ঞাপন দিতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। সার্ভিস চার্জের নামে মার্কেটে থাকা আট শতাধিক দোকান থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার করে চাঁদা তোলা হয়, যার বেশির ভাগই যায় সমিতির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের পকেটে।

তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর মার্কেট ও সমিতির নিয়ন্ত্রণে পরিবর্তন আসছে, নতুন কমিটি হয়েছে। সেই কমিটির নেতৃত্বে যিনি আসীন তিনি সম্প্রতি জেল থেকে মুক্তি পাওয়া পিচ্চি হেলালের ছোট ভাই দীপু। সেই দীপুই কাল রাতে আহত হয়েছে। সুতরাং দ্বন্দ্ব বা ভাগবাটোয়ারার ক্যাচাল স্পষ্ট। এটাই বড় কারণ মনে করেন ব্যবসায়ী সমিতির এ সদস্য।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার তারিক লতিফ বলেন, দুই ব্যবসায়ীর ওপর মার্কেটের সামনে অতর্কিতভাবে হামলার ঘটনায় জড়িতদের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শনাক্তের চেষ্টা করছি।

তবে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীন উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তদন্ত শুরু করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। সম্ভাব্য অপরাধী, চাঁদাবাজদের নজরদারির আওতায় আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি।

এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে ‘চাঁদার টাকা না পেয়ে’ স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ‘মুন্না ও চঞ্চলের’ গ্রুপের লোকজন এই হামলা চালায় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘হামলাকারী ১০-১২ জনের সবাইকে মাস্ক পরিহিত দেখা গেছে। আমরা বিষয়টা দেখছি, জড়িতদের নাম-পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করছি। জড়িতরা যেই হোক ছাড় দেওয়া হবে না।’

এদিকে মানববন্ধন করে দুই ব্যবসায়ীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ এবং নিন্দা প্রকাশ করে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে ইসিএস কম্পিউটার সিটি ব্যবসায়ীরা।

সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসিকতা ও দক্ষতার মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে প্রতিরোধে সহযোগিতার কথাও বলেন তারা।

এসময় ব্যবসায়ীরা সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সবাইকে একযোগে দাঁড়ানো; গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি; সরকারের উদ্যোগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা; সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখা ও বিশ্বের সামনে শান্তি, সহনশীলতা ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার দৃঢ়ভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানান।