
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন পর সুখবর— টানা তিন বছরের ঘাটতির পর অবশেষে বৈদেশিক লেনদেনে উদ্বৃত্তের ধারা ফিরেছে। নতুন অর্থবছরের শুরুতেও রিজার্ভ, রফতানি ও রেমিট্যান্স— এই তিন প্রধান সূচকে একযোগে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ভালো সাফল্য পেয়েছে। ইতোমধ্যে জুন মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সবমিলিয়ে, অর্থনীতির চাকা যেন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে, যা দীর্ঘ সময়ের অস্থিরতা ও চাপের পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিয়েছে।
তবে বিনিয়োগের খরা কাটছে যেন না। দেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। চলতি বছরের জুনের শেষে এ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি তৈরি হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি এলসি ২৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে। একই সময়ে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলারের সংকট, তারল্য ঘাটতি, খেলাপি ঋণের উচ্চ প্রবণতা এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট— সব মিলিয়ে বিনিয়োগ পরিবেশ অনুকূল নয়। ফলে আগামী ছয় মাসে বেসরকারি বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য উন্নতি আশা করছেন না ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
দেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। চলতি বছরের জুন শেষে এ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০০৩ সালের পর সর্বনিম্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, বিনিয়োগ স্থবিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ সুদহার এবং খেলাপি ঋণের চাপ—এই চারটি প্রধান কারণেই ঋণ প্রবৃদ্ধিতে টানা ধস চলছে।
গত বছরের জুলাইয়ে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, তা কমতে কমতে জুনে এসে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশে। এর আগে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছিল। করোনার কঠিন সময়েও এ হার সাড়ে ৭ শতাংশের নিচে নামেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিগত সরকারের আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই বর্তমানে পলাতক বা কারাবন্দি। ফলে এসব গ্রাহকের নতুন ঋণ পাওয়া তো দূরের কথা, পুরনো ঋণের বড় অংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধস
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ১৭৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯৮ কোটি ৫১ লাখ ডলারের, যা ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এর আগের বছরেও (২০২৩-২৪) এই খাতে এলসি খোলা কমেছিল ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এছাড়া শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যদিও শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলা সামান্য কমলেও নিষ্পত্তি বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
উচ্চ সুদের হার ও অনিশ্চয়তা বড় বাধা
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে নতুন বিনিয়োগে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে আগে রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কোনও উদ্যোক্তা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না।”
এদিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় নীতিসূদহার বাড়িয়েছে। এর প্রভাবে ব্যাংক ঋণের গ্রাহক সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, “মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া নতুন বিনিয়োগ না হওয়ারই ইঙ্গিত দেয়। উচ্চ সুদের হার এর একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ালেও, এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”
খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট আরও জটিলতা তৈরি করছে
ব্যাংকারদের ভাষ্য, জুন ২০২৫ শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট গভীর হয়েছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহ কমেছে। এতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাত ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটজনক সময় পার করছে। প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের জুন মাসের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ।
এই ঋণের পরিমাণ গত মার্চের চেয়ে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর ২০২৪ সালের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে ১৫১ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি।
সুদের হার ১৬ শতাংশ
এর পাশাপাশি বাজারে ঋণের সুদহারও বেড়ে গেছে। গত বছর এ সময় গড় সুদহার ছিল ৯ থেকে ১০ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ থেকে ১৬ শতাংশে। মে মাসে ঋণের গড় সুদহার ছিল ১২ দশমিক ১১ শতাংশ এবং আমানতের গড় সুদহার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।
তিন বছর পর ফের উদ্বৃত্ত
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিক লেনদেন বা সামগ্রিক ব্যালেন্সে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা গেছে, যেখানে আগের বছর ছিল ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি। শুধু চলতি হিসাবে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত এসেছে, যা আগের বছরের ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতির তুলনায় নাটকীয় পরিবর্তন। আর্থিক হিসাবেও (ফিনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণে এই পরিবর্তনের পেছনে মূলত চারটি কারণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে—
১. রেমিট্যান্স প্রবাহে তীব্র উল্লম্ফন, ২. বৈদেশিক সাহায্য ও বহিঋণ সহায়তার প্রবাহ বৃদ্ধি, ৩. ডলারের বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা এবং ৪. রাজস্ব ও আমদানি ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থান।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “চলতি ও আর্থিক— দুই হিসাবেই উদ্বৃত্ত অর্থনীতির জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বার্তা। রেমিট্যান্স ও বহিঋণ সহায়তার অগ্রগতি এই সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
তবে তিনি এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। তার ভাষায়, “বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়াতে হবে। কেবল ভোগ্যপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনৈতিক গতি টেকসই করতে পারবে না।”
রিজার্ভে আশার আলো
বহুল আলোচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও স্বস্তির ইঙ্গিত মিলেছে। সোমবার (৪ আগস্ট পর্যন্ত) বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০,০০০.৮১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুমোদিত ব্যালেন্স অব পেমেন্টস ম্যানুয়াল-৬ (বিপিএম৬) পদ্ধতিতে হিসাব করলে প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪,৯৭৭.৭২ মিলিয়ন বা প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন অ্যাসেটস অ্যান্ড ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট জানায়, গ্রস ও বিপিএম৬ পদ্ধতির এই ৫ বিলিয়ন ডলারের ব্যবধান মূলত স্বর্ণ, এসডিআর ও কিছু অপ্রবাহযোগ্য বিদেশি আমানতের হিসাব অন্তর্ভুক্ত বা অব্যবহৃত রাখার ভিত্তিতে তৈরি হয়। তবে রিজার্ভের এই পুনরুদ্ধার সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের উৎস হয়ে উঠেছে।